আল্লাহপাক চান তার বান্দারা যেন সহজ-সরল কথা বলে। মুখে যা বলে তাই যেন অন্তরে থাকে। মুখে এক আর অন্তরে আরেক, এমন লোকদের তিনি মোটেও ভালোবাসেন না। আমাদের অন্তরে কী আছে, তা তিনি খুব ভালো জানেন। তাই মানুষকে নানাভাবে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু আল্লাহপাককে ধোঁকা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তিনি প্রকাশ্য এবং গোপন, ভেতর এবং বাইরের সবকিছু সম্পর্কেই অবগত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতাআলা বলেন, ‘তুমি বলো, তোমাদের অন্তরে যা আছে তা তোমরা গোপন করো বা তা প্রকাশ করো আল্লাহ তা জানেন। আর আকাশসমূহে যা আছে এবং পৃথিবীতে যা আছে তিনি তাও জানেন। আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বশক্তিমান। সেদিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভালো কাজ করেছে, চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তাও, ওরা তখন কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান দীর্ঘ হতো! আল্লাহ তার নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আর আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি অতি মমতাশীল’ (সুরা আলে ইমরান : ২৯-৩০)। আল্লাহপাক মানুষের অন্তর এবং নিয়ত দেখে থাকেন। আমরা যতই ভালো কাজ করি না কেন, হৃদয় যদি স্বচ্ছ না হয় এবং অন্তর যদি পবিত্র না হয় তাহলে এসব আমল কোনোই কাজে লাগবে না। মূল বিষয় হলো, নিয়ত পবিত্র হতে হবে, কেননা আল্লাহ নিয়তকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, তিনি হজরত রাসুল করিম (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘তোমাদের আগের উম্মতের তিনজন লোক কোথাও চলার পথে বৃষ্টি এসে তাদের এক পর্বত গুহায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তারা সেখানে প্রবেশ করার পর একটি পাথর খসে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। তারা পরস্পর বলতে লাগল তোমরা একমাত্র আল্লাহর কাছে তোমাদের খাঁটি আমলকে মাধ্যম বানিয়ে দোয়া করলে এই পাথরের বিপদ থেকে মুক্তি পাবে। তাদের একজন বলল, হে আল্লাহ! আমার পিতা-মাতা অতিশয় বৃদ্ধ ছিলেন। আমি আমার পরিবারকে খাওয়ানোর আগেই তাদের দুধ পান করিয়ে দিতাম। একদিন কাঠের সন্ধানে আমাকে বহু দূর যেতে হলো এবং যথাসময়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারলাম না, এমনকি তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। এমন সময় তাদের জাগিয়ে তোলাকে আমি পছন্দ করলাম না। আবার তাদের আগে পরিবারকে দুধ খাওয়াতেও ভালো লাগছিল না। তাই আমি দুধের পেয়ালা হাতে নিয়ে তাদের জেগে ওঠার অপেক্ষায় রইলাম। অন্যদিকে সন্তানগুলো ক্ষুধায় আমার পায়ের কাছে কান্নাকাটি করছিল। এ অবস্থায় ভোর হয়ে গেল। তারা জেগে উঠলেন এবং দুধ খেলেন, হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজটি তোমারই সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি তাহলে এই পাথরের কারণে যে বিপদে পড়েছি তা দূর করে দাও, এতে পাথরটি কিছুটা সরে গেল। কিন্তু এর ফাঁক দিয়ে তারা বের হতে পারল না। দ্বিতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। আমি তাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসতাম। আমি তার সঙ্গে মিলনের প্রস্তাব দিলাম, কিন্তু সে তাতে রাজি হলো না। শেষে এক দুর্ভিক্ষের বছরে সে সাহায্য নেওয়ার জন্য আমার কাছে এলে আমার সঙ্গে নির্জনে মিলনের শর্তে ২২০টি মুদ্রা দিলাম। এতে সে রাজি হয়ে গেল। আমি যখন তাকে পেলাম, তখন সে বলল আল্লাহকে ভয় করো এবং অবৈধভাবে আমার কৌমার্য নষ্ট করো না। আমি তখনই তাকে ছেড়ে চলে গেলাম, অথচ মানুষের মধ্যে সে আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল। আমি তাকে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম। তা-ও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি, তাহলে আমাদের এ বিপদ দূর করে দাও। এতে পাথরখানা আরও কিছুটা সরে গেল, কিন্তু তাতেও তারা বের হতে পারল না। তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! কয়েকজন মজুর রেখেছিলাম। আমি তাদের সবাইকে মজুরি দিলাম। কিন্তু একজন তার মজুরি ছেড়ে চলে গেল। আমি তার মজুরিটি ব্যবসায় খাটালাম। তাতে ধনদৌলত অনেক বেড়ে গেল, কিছুকাল পর সে ব্যক্তি আমার কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমার মজুরি দাও, আমি বললাম যত উট, গরু, ছাগল, চাকর দেখছো এ সবই তোমার মজুরি। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করো না। তারপর সে সবকিছু নিয়ে চলে গেল এবং কিছুই রেখে গেল না। হে আল্লাহ! আমি যদি তোমারই সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজ করে থাকি, তবে আমাদের এ বিপদ থেকে মুক্তি দাও। তারপর পাথরটি সরে গেল এবং তারা সেখান থেকে বের হয়ে এলো’ (বোখারি ও মুসলিম)।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা সহজেই বোঝা যায়, আল্লাহতাআলা তার সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তকে কখনো বৃথা যেতে দেন না। মানুষের প্রতিটি কর্মের প্রতি তার দৃষ্টি রয়েছে, তাই আমাদের সবাইকে নিজেদের প্রতিটি কর্মে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। হৃদয় পবিত্র হতে হবে আর পবিত্র কর্ম ব্যতিরেকে তার নৈকট্য কখনো সম্ভব নয়। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে পবিত্র নিয়তে এবং আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির আশায় সব কাজ পবিত্র হৃদয়ে করার তৌফিক দান করুন, আমিন।