তারিক মো: মোরশেদ (নাসিম): সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস না করার কিম্ভূতকিমাকার এবং অথর্ব ফ্যাশন হাল আমলের মতো প্রাচীনকালেও ছিল। প্রাচীন পৃথিবীতে কিছু মানুষ নিজেদেরকে অন্যের আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্র বানানোর উদগ্র বাসনায় নাস্তিক সাজার ভান করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। আরেক শ্রেণীর লোক ব্যবসাবাণিজ্য, রাজনীতি কিংবা সমাজে বিশিষ্টজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সৃষ্টিকুল সম্পর্কে উদ্ভট কিছু প্রশ্ন তুলে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে ফেলতেন। কেউবা মন্দির, পুরোহিত কিংবা প্রচলিত মূর্তিপূজা ও দেবতার ওপর প্রাধান্য লাভের জন্য কখনো কখনো নিজেকে সৃষ্টিকর্তা বলে দাবি করে বসতেন, নতুবা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে নাস্তিক হওয়ার চেষ্টা করতেন।
পৃথিবীর কিতাবি ধর্ম মতের অনুসারী- ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানেরা তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে নাস্তিকদের ঘৃণা করেন এবং এই তিন সম্প্রদায়ের অনুসারীরা নাস্তিকতারোধে প্রায় সমস্বরে কথা বলে থাকেন। ইসলাম ধর্মে নাস্তিকতাবাদ এবং নাস্তিকদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যে বিশদ বর্ণনা রয়েছে, তা নিয়ে আজকের নিবন্ধে কোনো আলোচনা করব না। একজন মানুষ কী ধরনের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থায় পড়ে নাস্তিকতার দিকে পা বাড়ায় এবং সে পথ থেকে ফেরার জন্য তার সর্বপ্রথম কী করা উচিত, তা নিয়ে সাধ্যমতো আলোচনা করার চেষ্টা করব। নাস্তিকদের সম্পর্কে আমার প্রথম মূল্যায়ন হলো- এরা বিবেকহীন, ভণ্ড, প্রতারক ও লোভী প্রকৃতির। তারা কেবল একান্ত ব্যক্তিগত মান-অভিমান, লাভ-ক্ষতি ও লোভলালসার কথা চিন্তা করে বাবা-মা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও আত্মীয়স্বজনের সাথে নাফরমানি শুরু করেন; যা চূড়ান্তরূপে নাস্তিকতায় রূপান্তরিত হয়। এই শ্রেণীর মানুষ যদি সত্যিই নাস্তিকতার রোগ থেকে মুক্ত হতে চায়, তবে তাদের খুব বেশি কিছু করতে হবে না- একটি মশা নিয়ে সামান্য একটু চিন্তাভাবনা করলেই হয়তো তারা আস্তিক হওয়ার সহজ সরল পথ পেয়ে যাবেন অনায়াসে।
নাস্তিক এবং মশক প্রসঙ্গটি আমি আজকের আলোচনায় প্রাধান্য দিলাম এ কারণে যে, খুব স্থূলবুদ্ধির অশিক্ষিত নাস্তিকেরা সরলপ্রাণ আস্তিকদের বিভ্রান্ত করার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মশার প্রসঙ্গ তুলে আজগুবি সব কথাবার্তা বলতে থাকেন। যেমন- আল্লাহ কেন মশা সৃষ্টি করলেন? মশার কী প্রয়োজন?
আল্লাহ যদি মানুষকে ভালোইবাসেন, তবে মশা দিয়ে জ্বালাচ্ছেন কেন? এ ছাড়া তারা আরো বলে থাকেন- মশা ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু, কালাজ্বর, হলদেজ্বর, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জিকাভাইরাস প্রভৃতি মারাত্মক রোগের জন্মদাতা প্রাণী হিসেবে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী পতঙ্গ বলে ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ আস্তিকেরা আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার অপার দয়া ও রহমতের কথা এবং মানুষের প্রতি বিধাতার অসীম ভালোবাসার হাজারো নমুনার কথা লাখো কোটি মুখে প্রচার করেন, তারা একবার বলুন তো- মশা সৃষ্টির মাহাত্ম্য কী অথবা মশা দিয়ে কামড়িয়ে ডেঙ্গু অথবা ম্যালেরিয়ার রোগী বানিয়ে মৃত্যুর দ্বারে টেনে নেয়ার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার কেমনতরো ভালোবাসার নমুনা খুঁজে পান?
আজকের আলোচনায় অবশ্যই মশাসংক্রান্ত বিষয়ে নাস্তিকদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু তার আগে মশা নিয়ে তাদের কিছু প্রশ্ন করতে চাই। নাস্তিকদের দাবি মতে, আমি না হয় ধরেই নিলাম মশা ‘এমনি এমনি’ পয়দা হয়েছে। তারা বিনা কারণে পুনপুন করে ওড়ে এবং গুনগুন করে গান করে। তারা মানুষ, জন্তু-জানোয়ার, ফলমূল, ফুল, শস্যদানা ও খাদ্যদ্রব্য অকারণে কামড়ায় এবং প্রতিটি বস্তুর সুধারস শোষণ করে জীবন ধারণ করে ও বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। তারা এমনি এমনি জন্ম নেয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনিতেই মারা যায়। মশারা কোনো নিয়ম মানে না এবং জানে না। তারা খেয়ালখুশিমতো যাকে তাকে কামড়ায় এবং চালাক-চতুর প্রাণীদের খপ্পরে পড়ে অকারণে প্রাণ হারায়।
মশাসংক্রান্ত এসব সাদামাটা কথাবার্তার বাইরে খুব জানতে ইচ্ছে করে, কেন দুনিয়ায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে এবং কেন প্রত্যেক প্রজাতির মশার আকার-আকৃতি, খাদ্য, আচরণ ইত্যাদি ভিন্ন প্রকৃতির হয়। মশার কেন বিশাল বিশাল অর্থাৎ নিজেদের শরীরের চেয়ে বড় আকৃতির ছয়টি পা, মুখের সামনে তিনটি শুঁড় থাকে? আবার কোনো কোনো মশার কেনো শুঁড়ের সাথে লাগোয়া অতিরিক্ত দুটো বিশেষ আকৃতির পাখা, যা কিনা বিমানের প্রপেলারের মতো দেখায়; তা থাকে?
লেখাপড়া জানা নাস্তিকেরা নিশ্চয়ই জানেন, কেবল স্ত্রী-মশারাই রক্ত পান করে এবং সব মশা ‘গান’ গায় না। কিছু স্ত্রী-মশা রয়েছে, যারা কেবল বিষধর সাপের ফণার ওপর কামড় দিয়ে রক্ত শোষণ করে থাকে। আরেক শ্রেণীর স্ত্রী-মশা রক্ত শোষণ করে প্রথমত নিজের পেটের ময়লা ও দূষিত রক্ত ও বর্জ্য মলদ্বার দিয়ে বের করে। গাড়ির ইঞ্জিন যেভাবে ফ্লাশ করা হয় অথবা মানুষের পাকস্থলীতে বিষক্রিয়া হলে যেভাবে পেট ধৌত করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে কিছু স্ত্রী-মশা তরতাজা রক্ত দিয়ে আগে নিজের পাকস্থলী ফ্লাশ করে নেয় এবং তারপর পুরো পেট রক্ত দিয়ে ভর্তি করে ফেলে। এরা গড়ে নিজের শরীরের তুলনায় তিন গুণ বেশি ওজনের রক্ত পাকস্থলীতে ধারণ করে থাকে।
মশার মধ্যে একটি প্রজাতি রয়েছে, যারা মূলত দক্ষিণ আমেরিকার বিশেষ জঙ্গলে বাস করে এবং সেই জঙ্গলে বিশেষ এক ধরনের পাখির রক্ত খায়। বেশির ভাগ মশা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাস করে, বিকেলে সক্রিয় হয় এবং রাতের বেলায় কামড়াকামড়ি শুরু করে। তবে ‘এশিয়ান টাইগা’র নামে পরিচিত এক ধরনের মশা রয়েছে, যারা দিনের বেলায়ও কামড়াকামড়ি করে রক্ত শোষণকর্ম চালাতে থাকে। মশা প্রতি রাতে একনাগাড়ে চার ঘণ্টা উড়তে পারে এবং ১২ কিলোমিটার পথ অনায়াসে অতিক্রম করতে সক্ষম। মশা, বিশেষ করে পুরুষ মশার ডানা ঝাঁপটানোর গতি, ছন্দ ও তাল-লয় বিবেচনা করলে নাস্তিকদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কারণ, একটি পুরুষ মশা তার দুটো ডানা প্রতি সেকেন্ডে ৫৫০ থেকে ৮০০ বার পর্যন্ত ঝাঁপটিয়ে বিশেষ শব্দতরঙ্গ তৈরি করে থাকে। মশা সম্পর্কে উল্লিখিত সাধারণ তথ্যগুলো নিয়ে নাস্তিকেরা যদি একটু চিন্তাভাবনা করেন, তবে আস্তিক হওয়ার জন্য হাজারো উপায় ও পথ তারা পেয়েও যেতে পারেন। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে কোনো কিছুই অনর্থক পয়দা করেননি এবং প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যে বিশ্বজগতের সৃষ্টিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন রচনা আর সৃষ্টিকুলের ভারসাম্য রক্ষার মহামন্ত্র নিহিত রয়েছে। পাখির কলকাকলি, নদীর কুলকুল ধ্বনি, সূর্যের তাপ, চাঁদের আলো, মানুষের কথাবার্তার শব্দসমষ্টির যে শক্তি বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করে; তা প্রকৃতিকে কিভাবে সচল রাখে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ কয়েক হাজার বছর ধরে বিভিন্ন মত ও পথের জ্ঞানীগুণী ও বিজ্ঞানীরা মানবজাতিকে শুনিয়ে আসছেন। প্রায় সবার যোগসূত্র যে কেন্দ্রে গিয়ে মিলেছে, সে কেন্দ্রটির নাম সৃষ্টিকর্তা।
পৃথিবীর আদি থেকে আজ অবধি, প্রায় সবাই ছিলেন আস্তিক। বিভিন্ন ধর্মমত, পূজা-অর্চনা অথবা বনজঙ্গলে গিয়ে যেভাবেই আরাধনা করুক না কেন- সব মানুষই একজন মহাক্ষমতাধর সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল বা সঁপে দেয় মূলত আস্তিকতার কারণে। মানব ইতিহাসে আস্তিকের তুলনায় নাস্তিকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। কোনো কোনো সমাজে হয়তো হাজারে একজন, আবার কোনো কোনো সমাজে লাখে একজন নাস্তিকও খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে কোনো ধর্মমত, সম্প্রদায় কিংবা রাষ্ট্রশক্তি নাস্তিকদের নিয়ে ততক্ষণ মাথা ঘামায় না, যতক্ষণ একজন নাস্তিক রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে কিংবা রাষ্ট্রশক্তির তাঁবেদার হয়ে আস্তিকদের বিপথে নিয়ে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা না চালায়। তেমনটি করেছিলেন ইতিহাসের কুখ্যাত ফেরাউন।
আগেই বলেছি- একটি বিশেষ মতলব কিংবা স্বার্থ অথবা লোভকে সামনে রেখে কিছু মানুষ নাস্তিক হওয়ার চেষ্টা করে। কোনো মহৎ উদ্দেশ্য কিংবা কোনো কল্যাণকর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনোকালে কেউ নাস্তিক হয়েছেন- এমন একটি উদাহরণও পৃথিবীতে নেই। নাস্তিকেরা বিশেষ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য প্রায়ই নিজেদের কুকর্মের জন্য অপরিহার্য এমন তত্ত্ব-উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো জাহির করার জন্য ক্ষমতাবান হয়ে অথবা ক্ষমতাবানদের পদাশ্রয়ী হয়ে সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তারপর একদিন হঠাৎ করে কোনো এক তথাকথিত পণ্ডিতের আদলে তারা আবির্ভূত হয়ে সমাজে নানা ফেতনা ও ফাসাদ শুরু করে দেন। তারা কোনোকালে কেবল নিজেদের ক্ষতি ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেন না। তারপরও তাদের নিয়ে আস্তিকেরা উত্তেজিত হয় কেবল নাস্তিকদের বিরক্তিকর আচার-আচরণ ও কথাবার্তার জন্য। একটি মাছির ভন ভন শব্দ কিংবা ঘুমন্ত মানুষের নাকের ডগায় মাছি বসে যেভাবে চুলকানির সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনি নাস্তিকেরা পুরো সমাজকে নানাভাবে ভন ভন শব্দে এবং অপরিচ্ছন্ন স্পর্শে উত্তেজিত ও অস্থির করে তোলেন।
নাস্তিকেরা নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করার জন্য প্রায়ই বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। তারা সেগুলো পড়েন কেবল বক্রতা অনুসন্ধান করার জন্য। এরপর তারা গ্রন্থগুলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাধারণত দুই ধরনের কথাবার্তা বলে থাকেন। প্রথমত, তারা যখন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন, তখন বলেন- ওইসব কিতাবে তেমন কিছুই নেই, কেবল পুরনো গালগল্প ছাড়া। দ্বিতীয়ত, তারা যখন বিপদে পড়েন তখন বলেন- ওমুক ধর্মগ্রন্থের প্রথম থেকে শেষ অবধি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। তারপর সংশ্লিষ্ট গ্রন্থটিতে বর্ণিত কিছু উক্তি যা কিনা তার পিঠ ও পেট বাঁচানোর জন্য অপরিহার্য, সেগুলো লোকসমক্ষে বারবার উচ্চারণ করে বা উদ্ধৃতি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে তার ভক্তি-শ্রদ্ধা কোনো অংশে কম নয়। অথবা ধর্মগ্রন্থের বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে সে ধর্ম বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য জাহির করার অপচেষ্টা করে আস্তিকদের নতুন করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালান। মাঝে মধ্যে নাস্তিকেরা অবস্থার চাপে পড়ে বলতে থাকেন- আমরা নাস্তিক নই। তবে আসলে তারা কী, তা কিন্তু বলেন না। অর্থাৎ তারা যে আস্তিক সে কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না।
ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে আস্তিকেরা সব সময় অমৃত সুধারস এবং নাস্তিকেরা গরলতা অর্জন করেন। কেন এমনটি হয়, তা ইসলাম ধর্মের ঐশী গ্রন্থ আল কুরআনের প্রথম নাজিলকৃত অমিয় বাণীটি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে। একই উক্তির বিস্তৃত ও বিস্তারিত ব্যাখ্যার মধ্যেই আল্লাহ কর্তৃক মশা সৃষ্টির বহুবিধ ইতিবাচক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ওপর সর্বপ্রথম যে বাণীটি নাজিল হয়েছিল, তার শাব্দিক অর্থ হলো- ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে কলমের মাধ্যমে জ্ঞান দান করেছেন।’ এখানে চারটি শব্দ অর্থাৎ ‘পড়ো, তোমার প্রভু, জ্ঞান ও কলম’ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আজকের বিষয়বস্তুর যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করব।
ইসলামের উল্লিখিত ঐশী বাণীটির প্রথম দু’টি শব্দ অর্থাৎ ‘পড়ো এবং তোমার প্রভু’র মধ্যে একটি অন্তঃমিল রয়েছে- যেমনটি রয়েছে পরবর্তী দু’টি শব্দ অর্থাৎ ‘জ্ঞান ও কলমে’র মধ্যে। বাণীটির পুরো মর্মার্থ ও সার্থকতা শব্দ চারটির পরস্পরের সাথে এক দিকে যেমন সম্পর্কযুক্ত, অন্য দিকে তেমনি শর্তযুক্ত। আপনি যদি আপনার প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে কুরআন পাঠ করতে থাকেন, তবে কোনো কুরআনি অর্থাৎ ঐশ্বরিক জ্ঞান যাকে ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় হিকমাহ্, তা আপনার মন-মস্তিষ্কে ঢুকবে না এবং সেই জ্ঞান বাক্য আকারে আপনার মুখ দিয়ে অথবা কলম দিয়ে বের হবে না। দ্বিতীয়ত, মানব মনের এলোমেলো কিংবা উদ্ভট চিন্তাকে জ্ঞান বলা হয় না। জ্ঞান হলো সেসব চিন্তা-চেতনার শব্দগুচ্ছ বা কথামালা, যা জ্ঞানী ব্যক্তি নিজে কিংবা তার অনুসারীরা পৃথিবীর মানুষের জন্য লিখে রাখার প্রয়োজন অনুভব করেন। কাজেই কুরআনের এই উক্তির ভাবার্থ- লিখিত বিষয়ই হলো উত্তম জ্ঞান। নাস্তিকদের জন্য দুঃসংবাদ হলো- সব নাস্তিকের কাছে গ্রহণযোগ্য নাস্তিকতাবাদের প্রামাণ্য কোনো লিখিত দলিল নেই। বিভিন্ন সময় আবির্ভূত বিভিন্ন নাস্তিকের উদ্ভট চিন্তা ও বিশৃঙ্খল কথাবার্তা মুখ থেকে মুখান্তরে মহামারী বা ছোঁয়াচে রোগের মতো নাস্তিকতাবাদ ছড়াতে থাকে, যেভাবে মশা-মাছি বিভিন্ন রোগজীবাণু ছড়ায়।
নাস্তিকেরা হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার জন্য কেন অজু, গোসল, পাক-পবিত্রতা এবং প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনপূর্বক তার নাম উচ্চারণ করতে হবে? এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান অবদান কম্পিউটারকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো কম্পিউটার গবেষণাগারে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই ধুলো-ময়লা পরিহার করে, পরিচ্ছন্ন হয়ে ঢুকতে হবে ল্যাবটিকে ভাইরাসমুক্ত রাখার জন্য। দ্বিতীয়ত, কম্পিউটার ল্যাবের কম্পিউটার খোলার জন্য বা ব্যবহারের জন্য প্রত্যেক ব্যবহারকারীর একটি স্বতন্ত্র পাসওয়ার্ড থাকে। সেই পাসওয়ার্ড ছাড়া আপনি কম্পিউটারটির তথ্যভাণ্ডারে ঢুকতে পারবেন না। নাস্তিকেরা পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, এমন অনেক কম্পিউটার রয়েছে যেখানে পাসওয়ার্ড নেই এবং সেই কম্পিউটার চালানোর জন্য পরিচ্ছন্নতারও প্রয়োজন পড়ে না। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো- যেসব কম্পিউটারে মূল্যবান এবং অতি প্রয়োজনীয় অর্থাৎ কল্যাণকর গোপনীয় তথ্য সন্নিবেশিত থাকে, সেসব কম্পিউটার খুবই দামি ও শক্তিশালী হয় এবং তা খোলার জন্য ব্যবহারকারীকে অবশ্যই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। এমনকি কোনো হ্যাকারকে যদি তথ্য চুরির জন্য কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকতে হয়, তাকেও পাসওয়ার্ড দিয়ে অথবা পাসওয়ার্ড ব্রেক করে কাজ শুরু করতে হয়।
উল্লিখিত উদাহরণের আলোকে বলা যায়, আস্তিকেরা যখন তাদের প্রভুর নাম উচ্চারণ করে ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন, তখন তাদের পবিত্রতা ও প্রভুর নাম একটি জাদুকরী পাসওয়ার্ডের মতো কাজ করতে শুরু করে এবং ঐশী জ্ঞানের ভাণ্ডার তাদের কাছে সহজলভ্য হয়ে ওঠে। তারা ধর্মগ্রন্থ থেকে হিকমাহ অর্জন করেন এবং তাদের জীবনের সব কিছুর জন্য ইতিবাচক কারণ খুঁজে পান। একইভাবে তারা বুঝতে পারেন, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে মশার প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি হয় মূলত অপরিচ্ছন্নতার কারণে। প্রতিটি ধর্মেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাকে অবশ্য করণীয় করা হয়েছে। ইসলামে পবিত্রতাকে ‘ঈমানের অঙ্গ’ করা হয়েছে। কাজেই মানুষ যদি পরিচ্ছন্নতা ত্যাগ না করে তবে মশা-মাছির মতো আরো বহু দৃশ্যমান ও অদৃশ্য উৎপাত তাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। অধিকন্তু নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের আরামপ্রিয় মানুষ যাতে বেশিমাত্রায় বেখেয়াল ও অলস হয়ে অথর্ব প্রাণীতে পরিণত না হয়, সে জন্য কিছু প্রাকৃতিক উপকরণ- মশা, মাছি ও কীটপতঙ্গের মাধ্যমে মানুষকে সব সময় সজাগ, সতর্ক ও কর্মচঞ্চল রাখার যে কৌশল সৃষ্টিকর্তা তাদের দিয়েছেন; সে জন্য কৃতজ্ঞ বিশ্বাসী তাদের মালিকের সকাল-সন্ধ্যায় প্রশংসা করে থাকে।
Leave a Reply