তারিক মোঃ মোরশেদ (নাসিম): মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল বছর ত্রিশেক আগে। খুব সম্ভবত ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি ঢাকার শান্তিনগরে তমদ্দুন মজলিসের অফিসে তার সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছিলাম। তিনি তখন দেশের অন্যতম আলেমকুল শিরোমণি। খ্যাতি, যশ, মান-সম্মান এবং অর্থবিত্তে বিচারে তিনি এমন একটি অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন, যা অনুধাবন করার ক্ষমতা তৎকালীন সময়ে আমার মতো ক্ষুদ্র জ্ঞান অšে¦ষণকারীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরবর্তীকালে তার সাথে আমার যতবারই দেখাসাক্ষাৎ কিংবা কথাবার্তা হয়েছে, ততবারই আমি তার জ্ঞানগরিমা ও ব্যক্তিত্ব দ্বারা মুগ্ধ হয়েছি। এভাবে চলতে-ফিরতে গিয়ে প্রায় পনেরটি বছর চলে গেল। এই সুদীর্ঘ সময়ে কেবল তার কথাবার্তা এবং মাসিক মদীনায় তার প্রশ্নোত্তর পর্বগুলো পড়েই আমার মুগ্ধতার মাত্রা সীমিত রেখেছিলাম। তার বৃহৎ সাহিত্যকর্ম আর রচনাশৈলীর সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৯৯ সালের পর থেকে এবং বলতে গেলে তখন থেকেই মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের বহুমুখী প্রতিভা এবং ইসলামি শরিয়ত, তাহজিব তমদ্দুন এবং হেকমত সম্পর্কে সুগভীর পাণ্ডিত্য আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ ও বিস্মিত করতে থাকে।
গত ২৫ জুন রাজধানীর একটি হাসপাতালে তার ইন্তেকালের খবরটি প্রথমে জানতে পারি মাওলানা ইয়াসিন আরাফাত নামক একজন আলেমের কাছ থেকে। মাওলানা আরাফাত বেশ বড় একটি মসজিদের খতিব এবং আমার লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত। সে প্রায়ই আমার কাছে আসে পবিত্র আল কুরআনের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার জন্য। কথা প্রসঙ্গে একদিন আমি তাকে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রচিত কয়েকটি বই পড়ার উপদেশ দিলাম এবং একই সাথে গ্রন্থকারের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে কিঞ্চিত বর্ণনা করলাম। এরপর থেকে মাওলানা আরাফাতও আমার মতো মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের একনিষ্ঠ ভক্ত ও অনুরক্ত পাঠকে রূপান্তরিত হয়ে গেল। তার ভক্তি ও শ্রদ্ধার নমুনা টের পেলাম তার কান্নাবিজড়িত কণ্ঠের আওয়াজ এবং একটি আকুতি পেশের ধরন দেখে। সে আমাকে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ইন্তেকালের খবর জানাল এবং কাঁদতে কাঁদতে আমাকে অনুরোধ করল তার প্রিয় এই লেখক এবং মুহতারাম সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বেশ কিছুকাল ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় বেশ অসুস্থ ছিলেন। মৃত্যুর কিছু দিন আগে তাকে প্রথমে ইসলামি ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং অবস্থার অবনতি হলে ল্যাব এইড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তিনি পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেছেন; তবুও এই মৃত্যু আরো লাখো কোটি মুমিন-মুত্তাকির মতো আমাকেও নিদারুণভাবে বেদনাহত করেছে। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হুজুরের বইগুলোর দিকে বারবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছি এবং ভেবেছি, কত সুমহান কর্মনিষ্ঠা, একাগ্র পরিশ্রম এবং আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ জ্ঞানের সম্মিলন ঘটেছে ওগুলোর মধ্যে। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে নিজের জ্ঞানের দৈন্য খুব ভালোভাবে পুনরায় টের পেলাম। কোথা থেকে শুরু করবÑ কিভাবে শুরু করব অথবা নিবন্ধের শিরোনামই বা কী হবে ইত্যাকার চিন্তায় পার হয়ে গেল কয়েকটি দিন, যা সাধারণত সচরাচর আমার ক্ষেত্রে ঘটে না। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সম্পর্কে আমার হৃদয়ে ভালোবাসার আতিশয্য এবং ভক্তির ভাবাবেগের কারণেই তার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বারবার কলম কেঁপে উঠেছে এবং মাঝে মধ্যে থমকেও গিয়েছে।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের জীবন, আদর্শ, কর্ম, বিশ্বাস, ভালোবাসা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সার্থকতা, জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, মুসলিম উম্মাহর প্রতি দরদ, শরিয়তের সুগভীর পাণ্ডিত্য, আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সাহস-শক্তি, প্রভাব-প্রতিপত্তি, শিক্ষাদীক্ষা, সাহিত্য রসবোধ, লেখার ভঙ্গি এবং বিষয়বস্তুর শৈল্পিক মাধুর্য শত শত বিষয় রয়েছে; যা দিয়ে তিনি সেই ১৯৫৫ সাল থেকে মৃত্যু অবধি মুসলমানদের একটি বিরাট অংশকে তার কাছে ঋণী বানিয়ে রেখে গেছেন। তার সৃষ্টিশীলতা, চরিত্রের অনুপম নান্দনিকতা, রুখে দাঁড়ানোর দুরন্ত সাহস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম দিয়ে আগুনের ফুলকি এবং জবান দিয়ে বারুদের শক্তি বের করার দুর্বার সাধনা নিয়ে কিছু লিখতে পারার সক্ষমতা যে আমার নেই, তা বিলক্ষণ টের পেলাম তার সম্পর্কে কলম ধরতে গিয়ে।
সম্মানিত পাঠকগণের মধ্যে যারা মাওলানা মুহিউদ্দীন সম্পর্কে সম্যক অবগত নন, তারা হয়তো আজকের নিবন্ধের শুরুটা পড়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বেন আর ভাববেনÑ নিবন্ধকার সব কিছু ঠিক বলছেন তো? বিশ্বাস করুনÑ আমি যা বলছি, তা একেবারে অন্তর থেকেই। আপনাদের যদি বিশ্বাস না হয়, তবে আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার মুসলমানদেরকে জিজ্ঞাসা করুন। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৫ সাল অবধি সুদীর্ঘ কুড়িটি বছর ধরে মুহিউদ্দীন খান ওইসব অঞ্চলের নিপীড়িত মুসলিম উম্মাহর অধিকার প্রতিষ্ঠা, নির্যাতিতদের পুনর্বাসন এবং তাদেরকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তা বাংলাদেশ তো দূরের কথা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য কোনো আলেম পারেননি। সৌদি রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং রাবেতা আল আলম আল ইসলামি নামের মুসলমানদের বৃহত্তম সাহায্য সংস্থার সাথে জড়িত থাকার সুবাদে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম রাষ্ট্রের আলেম-ওলামা, রাজনীতিবিদ এবং শাসকবর্গের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার সেই ঘনিষ্ঠতা এবং পরিশ্রমের সুফল বাংলাদেশের আলেম-ওলামা এবং উম্মাহ কতটুকু পেয়েছেন তা বর্ণনা করতে বিরাট এক উপাখ্যানের প্রয়োজন হয়ে পড়বে।
সৌদি বাদশাহর আর্থিক আনুকূল্যে পবিত্র আল কুরআনের বঙ্গানুবাদ, সংক্ষিপ্ত তাফসির এবং গুরুত্বপূর্ণ টিকাসংবলিত পবিত্র কুরআনুল কারিম নামের একটি গ্রন্থ রচনা এবং তা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সমগ্র বাংলাভাষাভাষী মুসলমানদের মধ্যে বিতরণের দায়িত্ব পালন করেছেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। ১৯৯৭ সালের দিকে আমি উল্লিখিত সৃষ্টিকর্মের একটি কপি পাই। সঙ্কলনটির শিল্পসম্মত মুদ্রণ, অতি উচ্চমানের কাগজ, অনন্য বাইন্ডিং এবং চমৎকার অলঙ্করণের মধ্যে এমন ভাবগাম্ভীর্যময় সৌন্দর্য ও পবিত্রতা ফুটে উঠেছে যে, সেটি দেখামাত্র হাতে নেয়া এবং বুকে চেপে ধরে বারবার চুমু না খাওয়া পর্যন্ত মুমিন-মুত্তাকির অন্তর শীতল হবে না। সঙ্কলনটিতে পবিত্র কালামে পাকের বঙ্গানুবাদে যে মুন্সিয়ানা তিনি প্রদর্শন করেছেন, তা অন্য কারো সাথে তুলনীয় নয়। ঝরঝরে সহজ বাংলা, চলিত ভাষায় ছোট ছোট, বোধগম্য বাক্যের মাধ্যমে আয়াতগুলোর অনুবাদ এবং প্রাঞ্জল বর্ণনাভঙ্গির কারণে বাংলা ভাষায়ও সেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অর্থ জীবন্ত ও মূর্ত হয়ে উঠতে পারে, তা আলোচ্য কিতাবটি না পড়লে অনুধাবন করা যাবে না।
এবার গ্রন্থটির সংক্ষিপ্ত তাফসির ও টাকা সম্পর্কে কিছু বলা যাক। তাফসিরে কবির, তাফসিরে জালালাইন, তাফসিরে রুহুল বয়ান ও তাফসিরে ইবনে কাসিরের মতো পৃথিবীবিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ অধ্যয়নকারীরা মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের অনুবাদসংবলিত তাফসিরটি পড়লে আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। কারণ উল্লিখিত তাফসিরে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনা, উপাখ্যান অতি সংক্ষেপে অথচ বোধগম্য ও সহজবোধ্য করে পবিত্র কুরআনুল কারিমে সংযোজিত করা হয়েছে। কোনো বৃহৎ বিষয়কে অল্প ভাষায় বর্ণনা করার জন্য কী পরিমাণ মেধা, দক্ষতা ও লেখনীর কৌশল দরকার পড়ে, তা কেবল উচ্চমার্গের লেখক এবং বোদ্ধা পাঠককুলই অনুধাবন করতে সক্ষম। এই গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বোঝানোর জন্য টীকা সংযোজন। মুহিউদ্দীন খানের মতো উস্তাদ-উল-আল্লাম এবং উত্তম মুফাসসিরে কুরআনের পক্ষেই সম্ভব আল কুরআনের সাধারণ পাঠকদের মনের অবদমিত প্রশ্ন, বোঝার সমস্যা এবং হৃদয়ঙ্গম করার দাওয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া। ফলে তিনি কুরআনের কিছু শব্দ, চরিত্র, অক্ষর, ঘটনা ইত্যাদি বিষয়ে নিজস্ব মতামত টীকা আকারে সংযোজিত করেছেন, যা তাফসিরের মধ্যে উল্লেখ করা সম্ভব ছিল না। আল কুরআনের মতো একটি মহাগ্রন্থের নির্ভুল সঙ্কলন, নির্ভুল বঙ্গানুবাদ, সংক্ষিপ্ত তাফসির, টীকা সংযোজন, সম্পাদনা, অলঙ্করণ, গ্রন্থন, মুদ্রণ, বাইন্ডিং ও বিতরণÑ তা-ও আবার বিনামূল্যে এবং সারা দেশে এবং দুনিয়ার অন্য প্রান্তের বাংলাভাষী লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দুরূহ কাজটি কেবল তার মতো মহাকর্মবীরের পক্ষেই সম্ভব।
এই মহাগ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান যে মেধা, মননশীলতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তা বর্তমানের অন্য কোনো লেখকের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না বলতে পারব না। এবার তার অন্যান্য সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু বলা যাক। তার লিখিত মৌলিক অনুবাদ গ্রন্থের সংখ্যা এক শ’ পাঁচ। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে আমার কাছে মনে হয়েছে হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালি রহ: লিখিত পৃথিবীবিখ্যাত বই ‘এহইয়াও উলুমিদ্দিন’-এর অনুবাদ। সম্মানিত পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, ইমাম গাজ্জালি রহ:-এর এ বইটি হলো পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে মানব রচিত সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান মানবজাতির অমূল্য সম্পদরূপে বিবেচিত গ্রন্থটিকে সুনিপুণ ও সুদক্ষ কারিগরের মতো এত চমৎকারভাবে অনুবাদ করেছেন যে, বাংলাভাষাভাষী পাঠকদের একবারও মনে হবে না যে, এটি একটি অনুবাদকর্ম। বরং গ্রন্থটির সুধারস আস্বাদন করতে করতে পাঠকদের মনে হবেÑ স্বয়ং ইমাম গাজ্জালি রহ: উপস্থিত হয়ে পাঠকের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে তার বক্তব্যগুলো বাংলায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত খাসায়েসুল কুবরা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য এক অমূল্য দলিল এবং মহামূল্যবান রত্ন বলে চিরদিন চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম পণ্ডিত ও বুজুর্গ আল্লামা জালালুদ্দিন আব্দুর রহমান সিয়ুতী রহ: রচিত খাসায়েসুল কুবরা হলো সেই গ্রন্থ, যেখানে নবী করিম সা:-এর জীবনের আশ্চর্যজনক দিকগুলো সহি ও শুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে। বইটি সম্পর্কে খোদ আল্লামা সিয়ুতী রহ: বলেনÑ ‘আমার শ্রমসাধ্য এ রচনাটি এমন উচ্চ মর্তবাসম্পন্ন একখানা কিতাব, যার অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলেম ব্যক্তিমাত্রই সাক্ষ্য দেবেন। এটি এমন এক রহমতের মেঘখণ্ড, যার কল্যাণকর বারি সিঞ্চনে কাছে ও দূরের সবাই উপকৃত হবেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি অসাধারণ মূল্যবান রচনা। অন্যান্য সিরাত গ্রন্থের মোকাবেলায় এটি এমন একটি কিতাব, যাকে কোনো সম্রাটের মাথার মুকুটে সংস্থাপিত একখানা উজ্জ্বল হীরকখণ্ডের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে।… এটি এমন একটি সুগন্ধি ফুলের সাথেই শুধু তুলনীয় হতেপারেÑ যার সুগন্ধ কখনো বিনষ্ট হয় না।’
মুহিউদ্দীন খানের মৌলিক ও অমর কীর্তিগাথার নাম মাসিক মদীনা। একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা লক্ষাধিক সার্কুলেশন নিয়ে অর্ধশতাব্দীর চেয়েও বেশি সময় ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, নির্ভরতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার মানদণ্ডে টিকে থাকতে পারে, তার দ্বিতীয় নজির দুই বাংলার কোথাও নেই। এ পত্রিকাটির মাধ্যমে জনাব মুহিউদ্দীন খান যুগ যুগ ধরে লাখ লাখ মানুষের ধর্ম, জীবন ও আশা-আকাক্সার সাথে সম্পৃক্ত শত-সহস্র প্রশ্নের যে জবাব দিয়েছেন, তা অনাগত দিনে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি উত্তম ফিকাহের দলিল হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি, ইসলামি সাহিত্য ও সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাংবাদিকতা, ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবার আগে যেসব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের নাম চলে আসে, তাদের মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান নিশ্চয়ই অন্যতম পুরোধা। পাক-ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ-ভারতে মুসলিম রেনেসাঁ বা নবজাগরণের যে উন্মেষ স্যার সৈয়দ আহমদ, নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ শুরু করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মাওলানা আকরম খান, কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হাশিম, কবি মোজাম্মেল হক প্রমুখ সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ ও মনীষী। সেই ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা উবায়দুল হক, মাওলানা আমিনুল ইসলাম, ফুরফুরার পীর সাহেব, ফুলতলীর পীর সাহেব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় হুজুর, হাফেজ্জী হুজুর, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, কায়েদ সাহেব হুজুর, অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, অধ্যাপক আব্দুল গফুর, ড. আসকার ইবনে শাইখ, আখতার উল আলম, সানাউল্লাহ নুরী, প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রমুখ যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা আশির দশকে এসে অনেকটা সফলতার মুখ দেখেছে।
বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের মসজিদের নগরী রাজধানী ঢাকার অলিগলির শত-সহস্র মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে যারা পবিত্র জুমার দিনে খুতবা দেন অথবা সারা বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মুসলমানের খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন, ধর্মীয় শিক্ষক, প্রাত্যহিক জীবনের শরিয়তের বিধিবিধান বর্ণনাকারী আলেম-ওলামা অথবা দেশজুড়ে সারা বছরব্যাপী ওয়াজ মাহফিলে বয়ানকারী মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও শ্রবণকারী বানানোর জন্য যেসব সুদক্ষ কারিগর পঞ্চাশ বছর ধরে নিরলস ও অকান্ত পরিশ্রম করে মুসলমানদের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অন্যতম। আল্লার হুকুমে তার রূহ চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তিনি আমাদের মধ্যে রয়ে গেছেন স্বকীয় মহিমা, বর্ণাঢ্য কর্মময়তা ও সৃষ্টিশীলতার কারণে। তিনি আছেন; এবং থাকবেন আমাদের হৃদয়েÑ মন ও মস্তিষ্কে। তার অনন্য সৃষ্টিগুলো কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের যেমন আলোকবর্তিকা হিসেবে জান্নাতের পথ দেখাবে, তেমনি সদকায়ে জারিয়া হিসেবে মরহুম মাওলানাকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দয়া ও করুণা লাভের অছিলা হিসেবে পবিত্র জান্নাতুল ফেরদাউসে আসীন করার পুঁজি হয়ে থাকবে।