তারিক মো: মোরশেদ (নাসিম):পৃথিবী কত বড়? এ প্রশ্নটির উত্তর দিতে হলে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়তে হয়, আসলে পৃথিবী কত ছোট? এক কথায় এ প্রশ্নটির উত্তর হলো এ মহাবিশ্বের তুলনায় পৃথিবী এতই ছোট, এতই ছোট যে, একটি বিন্দুকে লাখ-কোটি ভাগ করলেও তার আকারের ধারে-কাছেও আসবে না এ পৃথিবী।
মেঘমুক্ত রাতের আকাশের দিকে তাকালে যে অসংখ্য আলোর বিন্দু দেখা যায় যাদের আমরা তারা (তারকা) বলে থাকি। এগুলো আসলে সবই জ্যোতিষ্ক (গ্রহ-নক্ষত্র)। কত জ্যোতিষ্ক আছে? আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মানুষ এ পর্যন্ত ১০০ কোটিরও বেশি নক্ষত্রের সন্ধান পেয়েছে। আর সন্ধান পায়নি, যা তার সংখ্যা এর কয়েক লাখ কোটি গুণ হবে বলে ধারণা। আকাশে উজ্জ্বল যে জ্যোতিষ্কের নিজস্ব আলো আছে তাকেই নক্ষত্র বলে। যেমন আমাদের সূর্য একটি নক্ষত্র। এ সূর্যের চার দিক ঘিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীসহ ৯টি গ্রহ, যাদের কোনো নিজস্ব আলো নেই। আর প্রতিটি গ্রহের চার দিকে আছে এক বা একাধিক উপগ্রহ। যেমন পৃথিবীর উপগ্রহটি হলো চাঁদ। এই যে নক্ষত্র সূর্য আর ৯টি গ্রহ মিলে জগতেরই নাম সৌরজগৎ। এমনি লাখ-কোটি নক্ষত্র জগৎ নিয়ে গড়ে উঠেছে এক-একটি ছায়াপথ। অসংখ্য লাখ-কোটি ছায়াপথ নিয়ে আবার গঠিত এক-একটি গ্যালাক্সি। আর এ রকম কোটি কোটি গ্যালাক্সি নিয়ে এ মহাজগৎ, যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সূর্য। পৃথিবী থেকে এটি ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরত্বে। আর এ দূরত্ব থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড লাগে। এ মহাবিশ্ব এতই অসীম যে, এখনো অসংখ্য নক্ষত্র জগৎ রয়েছে, যা থেকে পৃথিবী সৃষ্টির পর এ ৫০০ কোটি বছরেও (বর্তমান তথ্য মতে, মহাবিশ্বের বয়স ১৪০০ কোটি বছর) পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে পারেনি। এতই অসীম দূরত্বে রয়েছে এসব নক্ষত্র যে, এ বিশাল দূরত্বকে আর লাখ-কোটি মাইল দিয়েও প্রকাশ করা যায় না। তাই এ দূরত্ব প্রকাশ করা হয় আলোকবর্ষ বা লাইট ইয়ার দিয়ে। আলো প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। সে হিসাবে আলো এক বছরে ছয় লাখ কোটি মাইল দূরত্ব যেতে পারে। এক বছরে আলো এই যে ছয় লাখ কোটি মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে, এরই নাম এক আলোকবর্ষ। এরই ভিত্তিতে এখন যদি একটু ভাবি, পৃথিবী সৃষ্টির পর এক বছর নয়, এক হাজার বছর নয়, এক লাখ বছরও নয়, ৫০০ কোটি বছরেও অসংখ্য নক্ষত্র থেকে এখনো পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে পারেনি, তাহলে সেসব নক্ষত্রের দূরত্ব যে কত অসীম- এ সম্পর্কে মানুষের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে কী ধারণা করা যায়? মনে তো হয় যায় না। মানুষ বহু চেষ্টা করে মহাবিশ্বের পরিসীমা ৯১ বিলিয়ন আলোকবর্ষ অর্থাৎ ৫.৪৬দ্ধ১০২৫ মাইল বা ৫৪৬০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ মাইল পর্যন্ত মাপতে পেরেছে। এর পর আর মাপা সম্ভব হয়নি। তাহলে বুঝুন কী বিশাল ব্যাপার। এ জন্যই মানুষ তথা বিজ্ঞানীরা বিস্তৃত গবেষণা করে এই বলে ছেড়ে দিয়েছেন, এ মহাবিশ্ব অসীম, এর কোনো কূলকিনারা নেই, নেই কোনো কেন্দ্র, নেই প্রান্ত সীমা। যা কি না গবেষণারও প্রয়োজন ছিল না। কারণ মহাবিশ্ব যে অসীম আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন কুরআন শরিফে তা পরিষ্কার বলেই দিয়েছেন।
অন্যান্য বিজ্ঞানী ও কৃতী পুরুষের তথ্যভিত্তিক ঘোষণা ছাড়াও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাবিশ্ব বিজ্ঞানী কসমোলজিস্ট এবং আইনস্টাইনের পর সবচেয়ে প্রতিভাবান পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর নিরলস গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন, এ মহাবিশ্ব অসীম ও অনন্ত। আর এ মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে রয়েছেন এক মহান স্রষ্টা, যিনি এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে এর পরিচালনার সব বিধিবিধান নির্ধারণ করে দিলেও এর পরিচালন প্রক্রিয়ায় কখনো কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেন না। এ মহান স্রষ্টাকে অন্যরা কে কী নামে ডাকবে, তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে বিশ্বাসীরা অর্থাৎ মুসলমানেরা এ জগৎস্রষ্টাকে আল্লাহ বলেই ডাকেন। আল্লাহ তার চির শাশ্বত বাণী পবিত্র কুরআন শরিফে বিভিন্ন স্থানে যেমন বলেছেন, যা ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় নেতারা বা সহজভাবে বললে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ভাষায় হুজুরেরা অনেক উপলক্ষেই বলে থাকেন- মানুষের পুণ্যের জন্য পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ মানুষকে পরকালে বেহেশতে স্থান দেন। এও বলা হয়, এত পরিমাণ পুণ্য করলে এতটি বেহেশত তার জন্য বরাদ্দ করা হবে। এসব কথায় অন্যরা তো বলতেই পারেন, তবে আমাদের দেশের মুসলমান নামধারী অনেকেও ভ্রুকুঁচকে অনেক সময় প্রশ্ন করেন- পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে মহাপ্রলয় পর্যন্ত যে লাখ-কোটি মানুষ এ পৃথিবীতে এসেছে বা আসবে, তাদের জন্য এত কোটি কোটি বেহেশতের স্থান সঙ্কুলান কি সম্ভব? কিন্তু বিজ্ঞানীদের এ অসীম অনন্ত মহাবিশ্ব সম্পর্কিত বাস্তব তথ্যের পরও এতে কী আর কোনো সন্দেহ থাকে যে এটি খুবই সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। তবে অবিশ্বাসী কেউ বলতেই পারেন এটি সম্ভব হলেও মূল তথ্যটির বাস্তব সত্যতা কী আছে? অর্থাৎ আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ। এ প্রসঙ্গেই বলা যায়, আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়- আপনি যে পোশাকটি পরে আছেন তা কি শূন্য থেকে এসেছে? নিশ্চয়ই নয়, তা অবশ্যই কোনো না কোনো টেইলর প্রস্তুত করেছেন। তেমনি আমরা নিত্য যা কিছু গ্রহণ করি বা খাই অথবা যেসব উপকরণ ব্যবহার করছি তার প্রতিটি কোনো না কোনো প্রস্তুতকারকই প্রস্তুত করেছেন, কোনো জাদুকরের ফুঁতে আসেনি। অর্থাৎ অবশ্যই প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে আছেন একজন স্রষ্টা। তেমনি এ মহাবিশ্ব এবং তার সব জীব-জড় তাদের সৃষ্টির পেছনেও রয়েছেন এক মহান স্রষ্টা। এতে কোনোই সন্দেহ নেই, যাকে আপনি যেভাবেই ডাকুন না কেন- আমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেই বিশ্বাস করি। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহর কোনো শরিক নেই। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশক্তিমান। আল্লাহ এক নিরাকার মহাশক্তি। নিরাকার এই অর্থে যে, আল্লাহর আকার এতই বিশাল ও এতই দেদীপ্যমান যে, তা আমাদের অতি ক্ষুদ্র দৃষ্টিশক্তি বা কল্পনাশক্তির বাইরে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই। আল্লাহরই সৃষ্টি দু’টি প্রাণী হাতি ও পিঁপড়া। একটি পিঁপড়া যদি একটি হাতির পায়ের কাছে থাকে সে কি হাতিটিকে দেখতে পাবে? মোটেই না। হাতির তুলনায় সে এতই ছোট যে হাতির পায়ের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশও তার দৃষ্টিসীমায় আসবে না। হাতিটির আকার সম্পর্কে সে ধারণাই করতে পারবে না। একটি ক্ষুদ্র প্রাণী যদি আর একটি বড় প্রাণীর আকার সম্পর্কে ধারণাই করতে না পারে বা তার আকার ওর দৃষ্টি সীমানায় না কুলায় তাহলে আমরা অতি ক্ষুদ্র জীব মানুষ মহাস্রষ্টা আল্লাহর আকার আর ক্ষমতা সম্পর্কে কিভাবে ধারণা করব? এটি সম্পর্কে চিন্তা করাও বোকামি। কেউ যদি পিঁপড়াটিকে হাতির বিশাল আকার সম্পর্কে ধারণা দেয় সে হয়তো বলে বসতে পারে- ও, এত বিশাল? তাহলে সে তো ঈশ্বর। এটি তার মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর চিন্তার দীনতা। কারণ যত বিশাল, যত ক্ষমতার অধিকারীই হোক না কেন (যেমন কারুন, নমরুদ, ফেরাউন) একটি প্রাণী বা সর্বোচ্চ মানুষ কখনো ঈশ্বর হতে পারে না। কারণ অন্য কোনো শক্তি বা প্রাণীর কথা বাদই দিলাম, একজন মহাবুদ্ধিমান, মহাপরাক্রমশালী, ক্ষমতাধর মানুষ কি অতি ক্ষুদ্র একটি প্রাণী যেমন- পিঁপড়া সৃষ্টি করতে পারবে? তার জীবন দিতে পারবে? পারবে না- এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এরপরও নানাকালে নানা সমাজে একজন মানুষকে অন্য মানুষেরা ভগবান-ঈশ্বর বলে মেনেছে। কী নির্বুদ্ধিতা! সে ঈশ্বরই কয়েক দিন পরে অপর আর একজন মানুষের মতো মরে গেল। সে কি তার মৃত্যুকে ঠেকাতে পারল? পারল না। পারবে কিভাবে? সেও তো একজন মানুষই। ক্ষমতা সীমিত। একজন মানুষ যত শ্রদ্ধেয় গুণী-জ্ঞানী-ক্ষমতাধরই হোক, হতে পারেন তিনি মহামানব, ঈশ্বর ভগবান তো নন। এ অমোঘ সত্যটি আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব ততই মানব জাতির জন্য মঙ্গল। না হলে আমরা শুধু আমাদের সময় ও মেধার অপচয়ই ঘটাতে থাকব।
তাই আবারো বলছি, এটি প্রমাণিত হয়েছে এ মহাবিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি আছে তার কোনোটিই শূন্য থেকে আসেনি, সব সৃষ্টিই ঘটেছে একজন মহাস্রষ্টার নির্দেশে। আর সে মহাস্রষ্টাকে অন্যরা যে নামেই ডাকুক মুসলমানেরা তাঁকে আল্লাহ বলেই ডাকেন। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়- বিশ্বজগতের মহাস্রষ্টা অন্য কেউ নন, আল্লাহ এবং একমাত্র আল্লাহই। তিনি যেমন স্রষ্টা তেমনি তিনিই সব কিছুর মালিক, তিনিই আমাদের বিধাতা। তাঁর নির্দেশ ছাড়া এ মহাজগতে এতটুকুও কিছু নড়ে না। তিনি মহাশক্তি, তাঁর ক্ষমতা অসীম, যা মানুষের চিন্তাশক্তি বা কল্পনারও অতীত। এত যুক্তি আর প্রমাণের পরও কেউ কেউ মহান স্রষ্টার অস্তিত্বে যদি সন্দিহান হন সেটি তার নিজস্ব দায়, অন্য কারো নয়। সে ব্যাপারে কোনো বক্তব্যও নেই। বক্তব্য হলো- বিশ্বব্যাপী মুসলমান ঈমানদারদের সম্পর্কে। মনে হয় আমাদের যাদের ঈমানে কিছু দুর্বলতা আছে, চার দিকের পরিবেশের প্রভাবে ঈমান কিছুটা নড়বড়ে হয়ে গেছে, সময় এসেছে তাদের আমাদের সবার ঈমান সুদৃঢ় করার। আর ঈমানদারদের জন্য এতেই মুক্তি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এটি বোঝার তাওফিক দিন।