তারিক মো: মোরশেদ (নাসিম): ছোটবেলা থেকে বিনয় ও ভদ্রতার উপদেশ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি আমরা। রাস্তাঘাটে চলার পথে লেখা থাকে, ব্যবহারে বংশের পরিচয়। তবুও অশান্ত এই পৃথিবী। চার দিকে মানুষে মানুষে হানাহানিতে পাল্টে যাচ্ছে ব্যবহারের পরিচয়। প্রযুক্তির বদৌলতে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। সেই সাথে হারিয়েছিও অনেক মূল্যবান কিছু। যান্ত্রিক জীবনে আমাদের মধ্য থেকে দিন দিন বিনয় ও হাসিমুখের সরল সম্ভাষণ হারিয়ে যাচ্ছে। নিতান্ত পরিচিত কিংবা বন্ধুবান্ধব ছাড়া আমরা কারো সাথে হাসি মুখে কথা বলতে নারাজ। নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বিনয় ও সরলতা দুর্লভ হয়ে উঠেছে। আত্ম-অহমিকা আর অহঙ্কারের সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ আমরা। অন্যের কাছ থেকে সত্য মেনে নেয়াকে পরাজয় ধরা হয়। যার গলা যত উঁচু সে তত প্রকৃত বীর। ভুলে বসেছি মুসলমান হিসেবে আমাদের এ রকম আচরণ হতে পারে না। স্বার্থবিহীন উদার ও লৌকিকতামুক্ত অকৃত্রিম বিনয় এবং সবার সাথে মার্জিত ব্যবহার ইসলামের প্রথম শিক্ষা। কারণ এমন গুণাবলি দিয়েই তো আল্লাহ পাক প্রথমে তার পাঠানো নবীদের সুশোভিত করেছেন। তারপর দায়িত্ব দিয়েছেন নবুওয়াতের। তারপর মানুষকে কাছে টানার জন্য নবীদের হতে বলেছেন সরল ও সহজ ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
আল্লাহ পাক বলেছেন, আপনি আপনার অনুসারী মুমিনদের জন্য নিজেকে কোমল করে রাখুন’ (সূরা শুয়ারা : ২১৫)। আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন,‘আপনি যদি কঠোর হতেন তবে মানুষ আপনার কাছ থেকে দূরে সরে থাকত। আপনি তাদের ক্ষমা করতে থাকুন, তাদের জন্য মাগফিরাত প্রার্থনা করুন এবং তাদের নিয়ে পরামর্শ করুন’ (সূরা আল ইমরান : ১৫৯)। স্বয়ং আল্লাহ পাক তার প্রিয় মানুষটিকে শেখাচ্ছেন, কিভাবে সমাজে সবার সাথে তিনি মেলামেশা করবেন। সর্বময় গুণের অধিকারী মুহাম্মাদ সা:-কে শেখানোর মাধ্যমে বরং তিনি আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন।
বিনয়ের আসল অর্থ সত্যকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়া, হোক তা যে কারো কাছ থেকে। এর আর একটি অর্থ নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে না করা। প্রখ্যাত মনীষী হাসান বসরি বলেছেন, ‘নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার পর যে কারো সাথে সাক্ষাৎ হবে তাকে নিজের চেয়ে ভালো মনে করার নাম বিনয়।’ মুসলিম শরিফে ইয়াজ রা: বর্ণনা করেছেন, ‘একদিন রাসূল সা: আমাদের বললেন, আল্লাহ পাক আমার কাছে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন, যাতে তোমরা বিনয়ী হও। একে অন্যের ওপর গর্ব করবে না এবং রাগও হবে না। হজরত ঈসা আ: বলতেন পৃথিবীতে যারা বিনয়ী থাকবে কিয়ামতের দিন তাদের আনন্দ! তারা সেদিন আসনে বসে থাকবেন। যারা আজ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে মিলিয়ে দেয়, তারাই তো সর্বোচ্চ জান্নাতুন ফিরদাউসের প্রকৃত অধিকারী। এ পৃথিবীতে আমরা কী নিয়ে বড়াই করি? সামান্য বিত্তবৈভবে আমরা অন্যকে তুচ্ছ করি। আমরা ভুলে থাকি আমাদের ওপর রয়েছে এক মহান স্রষ্টা। আমরা পৃথিবীতে কী নিয়ে বড়াই করি? তিনি সব কিছু দেখছেন। হিসাবের খাতায় লিখে রাখা হচ্ছে। পরম শক্তিমান আল্লাহর বড়ত্ব এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব যার হৃদয়ে থাকে, সে জন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বেশি ভালোবাসে। মানুষের সাথে তার আচরণ বিনয় নম্রতায় মিশে থাকে। মুসনাদে আহমদে এক হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহ পাকের জন্য যে বেশি নিচু হবে ( এই বলে রাসূল নিজের হাতকে মাটির দিকে নামিয়ে দেখালেন), ‘নিজেকে বিনয়ী করে রাখবে, আল্লাহ পাক তাকে উঁচু করবেন’ (রাসূল তা হাতের ওপরের দিকে উঠিয়ে দেখালেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তাকে মানুষের কাছে সম্মানিত করবেন। মুসলিম শরিফের আর একটি হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘দান-সদকায় কখনো সম্পদ কমে না। ক্ষমা ও করুণায় ওই লোকটির সম্মান বাড়িয়ে দেন এবং যে আল্লাহর জন্য বিনয় দেখায় আল্লাহ তাকে উঁচুতে অবস্থান করে দেন। এমন বান্দার প্রশংসা করতে গিয়ে নিজের বান্দা বলে পরিচয় দিয়েছেন। আর পরম দয়াময়ের বান্দারা তো নম্র হয়ে হাঁটাচলা করে এবং কোনো মূর্খের সাথে দেখা হলে সালাম দিয়ে চলে যায়’ (সূরা ফুরকান : ৬৩)।
এখানে বাগি¦তণ্ডা কিংবা কারো সাথে রেগে যাওয়া তাদের স্বভাব নয়। অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘এই পরকাল তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি যারা পৃৃথিবীতে সম্মানের প্রার্থী হতো না। তারা সেখানে হাঙ্গামায় লিপ্ত হতো না। মুত্তাকিদের জন্য তো শুভ পরিণাম’ (সূরা কাসাস : ৮৩)। ইবনে মাজা থেকে বর্ণিত হাদিসে দেখা যায়, রাসূল সা:-এর সামনে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছিল এক গ্রাম্য বেদুঈন। সে ভাবছিল কত বড় রাসূল এবং কত প্রতাপশালী শাসক তিনি। প্রিয়তম নবী তাকে অভয় দান করে বললেন, ‘তুমি শান্ত হও। আমি কুরাইশ বংশের এক সাধারণ মহিলার সন্তান, যে মহিলা রোদে শুকনো গোশত খেয়ে জীবন কাটাতেন।’ বুখারি মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূল সা: আরো বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো কারা জান্নাতের অধিবাসী? যারা দুর্বল এবং যাদের দুর্বল ভাবা হতো। অথচ তারা যদি আল্লাহর নামে শপথ করে, অবশ্যই তিনি তা পূরণ করে দেন।’ তিরমিজি শরীফে হাদিসে রাসূল সা: সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘মৃত্যুকালে যে মুসলমান অহঙ্কার, উগ্রতা ও বাড়াবাড়ি ও ঋণ থেকে মুক্ত সে জান্নাতে যাবে।’
ধরাধামের বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন আমাদের নবী। এমন সম্মানিত মানুষ হয়েও কি অসাধারণ বিনয় ও ঔদার্যের মায়াজালে তিনি পথ ভোলা মানুষকে কাছে টেনেছেন। কোনো মহিলা ভরা মজলিসে তাকে ডাকলে তিনি চলে যেতেন। তার প্রয়োজনের কথা শুনতেন। মদিনায় কারো অসুস্থতা কিংবা মৃত্যুর সংবাদ শুনলে ছুটে যেতেন। সান্ত্বনা দিতেন। নিজের হাতে ঘরের কাজ কর্ম করতেন। স্ত্রীদের সংসারে সাহায্য করতেন। তাঁর কোমলতার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। নবী মুহাম্মাদ সা: ছাড়া আর কে পেরেছে নিজেকে বিলিয়ে মানুষকে ভালোবাসা শেখাতে? তিনি তো প্রথম বলেছিলেন, আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্বের প্রথম সোপান এ বিনয় ও নম্রতা।’ আর অহঙ্কার ও উগ্রতায় তিনি রাগান্বিত হন। আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করি। সমাজই আমাদের জীবনের প্রথম বিচরণ ক্ষেত্র। ইসলামি সমাজ গঠনে ব্যক্তির সৎ আচরণ, সৎ চরিত্র, সৎ স্বভাব এবং নম্রতা, কোমলতা ও সৌজন্য বোধের গুরুত্ব অপরিসীম।