মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এই পৃথিবীতে প্রেরিত অসংখ্য নবী-রাসূলদের মধ্যে হজরত ইবরাহিম আঃ শ্রেষ্ঠ একজন নবী। তিনি ছিলেন আল্লাহ তায়ালার খুবই প্রিয়ভাজন নবী। তাই তাঁকে খলিলুল্লাহ বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা তাকে পৌত্তলিকতা ধ্বংস করে একত্মবাদ প্রচার করার নির্দেশ দেন। তিনি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ ইয়াহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম উম্মাহর আদিপুরুষ। তিনি হজরত নূহ আঃ-এর বংশধর ছিলেন। হজরত ইবরাহিম আঃ-এর বংশে হজরত ইসমাইল আঃ, হজরত ইসহাক আঃ, হজরত ইয়াকুব আঃ, হজরত মূসা আঃ, হজরত ঈসা আঃ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহামম্দ মোস্তফা সাঃ জন্মগ্রহণ করেন। হজরত ঈসা আঃ-এর আগমনের প্রায় দুই হাজার বছর আগে মানবসভ্যতার আদি ভূখণ্ড বর্তমান এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার মিলন এলাকার অন্তর্ভুক্ত মেসোপটোমিয়া বর্তমান ইরাকের কুফার অদূরে ফোরাত নদীর তীরে ‘উর’ নগরীতে হজরত ইবরাহিম আঃ-এর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম ছিল ‘তারিক’ কিন্তু পবিত্র কুরআন শরিফের সূরা আনআমের ৭৪ নম্বর আয়াতে তাঁর পিতাকে ‘আজর’ বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে ও বাইবেলে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হজরত ইবরাহিম আঃ-এর বংশপরম্পরায় বহুসংখ্যক নবী দুনিয়ায় আগমন করেন। এই কারণে তাঁকে ‘নবীদের পিতা’ বলা হয়। তাঁর সময়ে আদম সন্তানের পূর্বেকার পরিবার, গোষ্ঠী, গোত্র পরিচিতির গণ্ডি পেরিয়ে ‘মিল্লাতে ইবরাহিম’ নামে জাতিগত পরিচিতি লাভ করে।
হজরত আদম আঃ থেকে হজরত ইবরাহিম আঃ পর্যন্ত বংশানুক্রমে নবী-রাসূলগণের ধারাবাহিক আগমনের পর হজরত ইবরাহিম আঃ-এর বংশেই দুই ধারায় নবী-রাসূলের আবির্ভাবসহ মানবসভ্যতার ব্যাপক বিকাশ ও বিস্তার লাভ করেছে। এক ধারায় আদিপুরুষ হলেন হজরত ইবরাহিম আঃ-এর ঔরসে বিবি হাজেরার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী হজরত ইসমাইল আঃ এবং অপর ধারায় আদিপুরুষ হলেন একই ঔরসে বিবি সারার গর্ভে হজরত ইসহাক আঃ। রহস্য হলো, প্রথমোক্ত পুরুষের বংশে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ ছাড়া অন্য কোনো নবীর আর্বিভাব ঘটেছে বলে জানা যায় না। এবং অন্য আর সব নবীর আগমন হয়েছে শেষোক্ত পুরুষের বংশে, সেটা প্রত্যক্ষভাবে হউক কিংবা পরোক্ষভাবে। হজরত ঈসা আঃ-এর পর এ ধারায় ইবরাহিমি দ্বীনের বিকৃতি ঘটে এবং ইসলামের আসল রূপ যেন এখানে হারিয়ে যায়। কিন্তু পবিত্র কুরআনের সূরা হজের ৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, তোমাদের পিতা ইবরাহিমের ধর্মে কায়েম থাক। তিনিই তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন পূর্বেও এবং এই কুরআনেও। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা বানাব’ (সূরা বাকারা : ১২৪)। আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ তাঁর প্রচারিত ধর্মে মিল্লাতে ইবরাহিম আঃ-এর পন্থা প্রবর্তন করেন। ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ ১০টি ইবরাহিমি সুন্নত ছাড়াও কাবা শরিফের ঐতিহ্য ও পুরো হজকার্যক্রমসহ মুসলিম দুনিয়ার কোটি কোটি ঈমানদার নর-নারী প্রতিদিন অন্তত পাঁচবার নামাজের মধ্যে হজরত ইবরাহিম আঃ-এর নাম উচ্চারণ করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে মিল্লাতে ইবরাহিমের বাস্তব রূপই হচ্ছে ইসলাম অর্থাৎ হচ্ছে সব নবী-রাসূলের ধর্মের পুনর্গঠিত রূপ।
হজরত ইবরাহিম আঃ-কে তাঁর পালন কর্তা কয়েকটি বিষয়ে কঠিন পরীক্ষা করেছিলেন, ইবরাহিম আঃ তা পূর্ণ করেন। হজরত ইবরাহিম আঃ নিজেকে একান্তভাবে আল্লাহর অভিপ্রায় এর কাছে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। বস্তুত নিজের যা কিছু আছে সবই পরম প্রিয় মাওলার কাছে সমর্পণ করার নামই হচ্ছে ইসলাম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য নিবেদিত’ (সূরা আনআম : ১৬২)।
আল্লাহর খলিল ইবরাহিম আঃ মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে একত্মবাদে বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য বাদশাহ্ নমরুদের প্রতি আহ্বান জানালে বাদশাহ্ ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে। আল্লাহ তায়ালা আগুনকে নির্দেশ দিলেন, ‘হে আগুন! তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও ঠান্ডা হয়ে যাও।’ (সূরা আম্বিয়া : ৬৯)। পরে আল্লাহর অপার কুদরতে ইবরাহিম আঃ অগ্নিকুণ্ড থেকে অক্ষত বেরিয়ে আসেন। অতঃপর স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুষ্পুত্র লুত আঃ-কে সাথে নিয়ে জন্মভূমি থেকে হিজরত করে বিভিন্ন এলাকা সফর শেষে সিরিয়ার অন্তর্গত ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি সস্ত্রীক মিশর গমন করেন। বাদশাহ ফেরাউন কর্তৃক বিবি সারা আটক হওয়া ও বাদশাহর ওপর আল্লাহর গজব নিপতিত হওয়া এবং বাদশাহর মেয়ে হাজেরাকে হাদিয়া হিসেবে পুণ্যশীলা বিবি সারার হাতে তুলে দিয়ে সসম্মানে বিদায় দেয়ার ঘটনার পর ইবরাহিম আঃ হাজেরাসহ সস্ত্রীক ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। সন্তানহীনা বিবি সারা এক সময় স্বামী ইবরাহিমের কাছে হাজেরাকে অর্পণ করেন। এরপর তারা খুব আনন্দে দিনাতিপাত করছিলেন। হজরত ইবরাহিম আঃ বয়স পেয়েছিলেন ১৭৫ বছর। ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর কোনো সন্তানসন্ততি ছিল না। তাই তিনি মহান আল্লাহর দরবারে একটি নেক সন্তানের জন্য দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করে তাকে একটি নেক সন্তানের সুসংবাদ প্রদান করেন। হজরত ইবরাহিমের ঔরসে ও হাজেরার গর্ভেই হজরত ইসমাইল আঃ-এর জন্ম। আল কুরআনের সাক্ষ্য মতে, লুত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার জন্য আগত একদল ফেরেশতা হজরত ইবরাহিম আঃ-এর মেহমান হয়ে ইবরাহিমের ঔরসে সারার গর্ভে এক পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দেন। সেই সন্তানই হলেন হজরত ইসহাক আঃ। তখন ইবরাহিম আঃ-এর বয়স ছিল ৮৬ বছর। আল্লাহ তায়ালার কোনো এক রহস্য হেতু ইবরাহিম আঃ শিশুপুত্র ইসমাঈলসহ বিবি হাজেরাকে ফিলিস্তিন থেকে সুদুর আরবের মরু প্রান্তরে জনমানব, গাছপালা ও পানিহীন মক্কায় কাবাগৃহের সন্নিকটে নির্বাসনে দিয়ে ফিলিস্তিনে ফিরে যান। ওই নির্বাসনকে কেন্দ্র করে সেখানে জমজম কুয়ার সৃষ্টি, অতঃপর মানববসতি শুরু হয়। শিশু ইসমাঈল যখন বালক বয়সে পৌঁছেন, তখন তাকে কোরবানি করার জন্য পিতা ইবরাহিম আঃ স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত হয়ে মক্কায় আসেন। আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনে নিবেদিতপ্রাণ হজরত ইবরাহিম আঃ মিনায় পুত্র ইসমাঈলের ললাট জমিনে স্থাপন করে ছুরি চালাতে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হননি। ঐতিহাসিকদের মতে হজরত ইবরাহিম আঃ মোট চারবার পবিত্র মক্কা এসেছিলেন। এর মধ্যে তিনি দ্বিতীয়বার মক্কায় এসে পিতা-পুত্র মিলে কাবাঘর নির্মাণ করে আল্লাহর নির্দেশে দুনিয়ার লোকজনকে এখানে এসে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও কোরবানিসহ হজ পালনের আহ্বান জানান। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘যখন আমি ইবরাহিমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরিক কোরো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারী, নামাজে দণ্ডায়মানকারী এবং রুকু-সিজদাহকারীদের জন্য। এবং মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার করো। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। (সূরা হাজ : ২৬-২৭)। যে স্থানে দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম আঃ নির্মাণকাজ তদারকি করেছিলেন তা ‘মাকামে ইবরাহিম’ নামে পরিচিত। এটি একটি বরকতের স্থান। বর্তমানে মক্কা শরিফে এটিকে রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এাবং এর অভ্যন্তরে রুপার তৈরি এক জোড়া জুতা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী মুসলমানরাই হজরত ইবরাহিম আঃ-এর সার্থক উত্তরাধিকারী। আখিরি নবী হজরত মুহাম্মদ সাঃ হলেন হজরত ইবরাহিম আঃ ও হজরত ইসমাঈল আঃ-এর দোয়ার ফসল। কাবাঘর নির্মাণ শেষ হলে পিতা-পুত্রের দোয়ার মধ্যে সে-ও ছিল যে, শেষ নবী যেন তাদের বংশেই জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহ বলেন, স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম ও ইসমাঈল কাবাঘরের ভিত্তিস্থঅপন করেছিল। তারা দোয়া করেছিল, হে পরওয়ার দেগার! আমাদের থেকে কবুল করো। নিশ্চয় তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ। পরওয়ার দেগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো। (সূরা বাকারাহ-১২৭-১২৮)। আল্লাহ তায়ালা তাদের দোয়া কবুল করেছেন এবং কাবাগৃহের পাশে ইসমাইলিয়া কোরাইশ বংশে শেষ নবীর আবির্ভাব ঘটে।
মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে লক্ষ করে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন- ‘হে নবী আপনি বলুন, আমরা তো ইবরাহিমের ধর্মের উপর থাকবো, যেখানে কোনো বক্রতা নেই। ইবরাহিম মুশরিক ছিলেন না। বল, হে ইবরাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার আওলাদের প্রতি। আর উহার প্রতিও যা মুসা ও ঈসাকে আঃ প্রদান করা হয়েছে (সূরা আনআম : ১৬১)। বস্তুত হজরত ইবরহিম আঃ আল্লাহ তায়ালার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পনের যে অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছেন, তা যেমন অতুলনীয়, তেমনিভাবে চির অনুসরণীয়।
মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হজরত ইবরাহিম আঃ আবু কুবাইস পাহাড়ে বিশ্ববাসীর মধ্যে হজের ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। তাই তো ইবরাহিম আঃ-এর আহ্বানে সাড়া দানকারী আল্লাহর লাখ লাখ মেহমান এখন পবিত্র মক্কাতুল মোকাররামা ও মদিনা তাইয়্যেবায় অবস্থান করছেন। তাঁরা সেখানে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আঃ-কে প্রাণভরে স্মরণ করছেন, আর অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করে মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত কামনা করছেন।