তারিক মো: মোরশেদ (নাসিম):সূরা হুজরাত আল কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। মাত্র ১৮টি আয়াতে মুসলমানদের এমন আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও আচরণ শিক্ষা দেয়া হয়েছে, যা তাদের ঈমানদারসুলভ স্বভাব-চরিত্র ও ভাবমর্যাদার উপযুক্ত ও মানানসই এবং একটি সুস্থ ও পরিশীলিত সমাজ বিনির্মাণে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নিম্নে শিষ্টাচারগুলো ব্যক্ত করা হলো-
০১. ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না’ এটা ঈমানের প্রাথমিক ও মৌলিক দাবি। যে ব্যক্তি আল্লাহকে তার রব ও রাসূল সা:-কে তার হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনকারী মানে সে যদি তার এ বিশ্বাসে সত্যবাদী হয়ে থাকে, তাহলে সে নিজের মতামত ও ধ্যান-ধারণাকে কখনো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তের চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে পারে না, কিংবা বিভিন্ন ব্যাপারে স্বাধীন মতামত পোষণ করতে পারে না।
এ নির্দেশটি শুধু মুসলমানদের ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোর মধ্যে আবদ্ধ নয়, বরং তাদের সব সামাজিক ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে এটি ইসলামি আইনের মৌলিক দফা। মুসলমানদের সরকার, বিচারালয় ও পার্লামেন্ট কোনো কিছুই এ আইন থেকে মুক্ত নয়।
০২. ‘হে মুমিনগণ! নিজেদের আওয়াজ রাসূলের আওয়াজের চেয়ে উঁচু করো না’। যদিও রাসূল সা: মজলিসে যারা ওঠাবসা ও যাতায়াত করতেন, তাদের এ আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যখনই নবী সা:-এর আলোচনা হবে কিংবা তাঁর কোনো নির্দেশ শুনানো হবে অথবা তাঁর হাদিসগুলো বর্ণনা করা হবে এরূপ সব ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ের লোকদেরও এ আদব-কায়দাই অনুসরণ করতে হবে।
০৩. ‘হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসেক তোমাদের কাছে কোনো খবর নিয়ে আসে তাহলে তা অনুসন্ধান করে দেখো’। এ আয়াত নাজিলের একটি পটভূমি রয়েছে। পটভূমি যা-ই হোক, এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো যে, যেকোনো নাজুক পরিস্থিতিতে যখন একটি ভিত্তিহীন খবরের ওপর নির্ভর করার কারণে একটি বড় ভুল সংঘটিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সে মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের এ মৌলিক নির্দেশটি জানিয়ে দিলেন, ‘যখন তোমরা এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবে; যার ভিত্তিতে বড় রকমের কোনো ঘটনা সংঘটিত হতে পারে, তখন তা বিশ্বাস করার আগে খবরের বাহক কেমন ব্যক্তি তা যাচাই করে দেখো।
০৪. ‘ইমানদারদের মধ্যে দুটো দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।’ এ নির্দেশের মাধ্যমে এমন সব মুসলমানকে সম্বোধন করা হয়েছে, যারা ওই বিবদমান দল দুটোতে শামিল নয় এবং যাদের পক্ষে যুদ্ধমান দুটো দলের মধ্যে সন্ধি ও সমঝোতা করে দেয়া সম্ভব।
০৫. ‘হে ইমানদারগণ! পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রƒপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রƒপ না করে। হতে পারে তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরকে বিদ্রƒপ করো না এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না।’
বিদ্রƒপ করার অর্থ কেবল কথার দিয়ে হাসি-তামাশা করাই নয়। বরং কারো কোনো কাজের অভিনয় করা, তার প্রতি ইঙ্গিত করা, তার কথা, কাজ, চেহারা বা পোশাক নিয়ে হাসাহাসি করা অথবা তার কোনো ত্র“টি বা দোষের দিকে এমনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাতে অন্যদের হাসি পায়। এসবই হাসি-তামাশার অন্তর্ভুক্ত। মূল নিষিদ্ধ বিষয় হলোÑ কেউ যেন কোনোভাবেই কাউকে উপহাস ও হাসি-তামাশার বস্তু না বানায়।
‘এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না’। এ নির্দেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনো ব্যক্তিকে এমন নামে যেন ডাকা না হয়, অথবা এমন উপাধি না দেয়া হয়, যা তার অপছন্দ এবং যা দিয়ে তার অবমাননা ও অমর্যাদা হয়।
০৬. ‘হে ইমানদারগণ! বেশি বেশি ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো, কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গোনাহ।’ একেবারেই ধারণা নিষেধ করা হয়নি। বরং খুব বেশি ধারণার ভিত্তিতে কাজ করতে এবং সব রকম ধারণার অনুসরণ থেকে মানা করা হয়েছে। এর কারণ বলা হয়েছেÑ অনেক ধারণা গোনাহের পর্যায়ে পড়ে।
০৭. ‘দোষ অন্বেষণ করো না’। অর্থাৎ মানুষের গোপন বিষয় তালাশ করো না। একজন আরেকজনের দোষ খুঁজে বেড়িও না। অন্যদের অবস্থা ও ব্যাপার স্যাপার অনুসন্ধান করে বেড়াবে না। খারাপ ধারণার বশবর্তী হয়ে হোক, কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য করা হোক অথবা শুধু কৌতূহল ও ঔৎসুক্য নিবারণের জন্য করা হোক শরিয়তের দৃষ্টিতে সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ।
০৮. ‘আর তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে’। সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এটি একটি মারাত্মক অস্ত্র। গিবত হচ্ছে, ‘কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বলা যা শুনলে সে অপছন্দ করবে। স্বয়ং রাসূল সা: থেকে গিবতের এ সংজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া অসাক্ষাতে কারো নিন্দাবাদ একেবারেই হারাম। এ নিন্দাবাদ সত্য হলে তা গিবত, মিথ্যা হলে অপবাদ এবং দু’জনের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হলে চোগলখোরি। ইসলামি শরিয়তে এ তিনটি জিনিসকেই হারাম করে দিয়েছে। ইসলামি সমাজে প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছেÑ যদি তার সামনে অন্য কোনো ব্যক্তির ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ হতে থাকে, তাহলে সে যেন চুপ করে তা না শোনে বরং তার প্রতিবাদ করে। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা গিবতকে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার তুলনা করে এ কাজের চরম ঘৃণীত হওয়ার ধারণা দিয়েছেন।