মুমিন এবং মুত্তাকিগণ হররোজ এবং অহরহ আল-কোরআনের যেসব শব্দমালা উচ্চারণ করে থাকেন সেগুলোর মধ্যে সুবহা-নাল্লাহ অন্যতম। বরকতময় এই শব্দটির রুহানি ফায়েজ একজন মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বোচ্চ কল্যাণের পথে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম। যখন জমিনের কোনো বান্দা কিংবা বান্দী পরিপূর্ণ মহব্বত এবং সোহবত সহকারে শব্দটির অর্থ বুঝে আল্লাহপাকের জাত ও সেপাত স্মরণ করে সুবহা-নাল্লাহ উচ্চারণ করতে পারে তখন আসমান-জমিনের সব খোদায়ী নেয়ামতের দরজা খুলে যায়। কোনো একজন মানুষকে যদি তাবৎ দুনিয়ার সব নেয়ামত এবং ভূ-অভ্যন্তরে লুকায়িত সম্পদরাজি ও আসমানের ধনসম্পদ দান করা হয় তবে লোকটি যতটা খুশি হবেন তারচেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বেশি খুশি হন যদি কোনো বান্দা তার শান ও মান বুঝে একবার সুবহা-নাল্লাহ উচ্চারণ করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, শব্দটির অর্থ কি এবং আল্লাহর অগুনিত মানমর্যাদার সঙ্গে সেই অর্থের মিল-মহব্বতের সমন্বয় কীভাবে সম্ভব। প্রথমে অর্থ বলে নিই- তারপর ধীরে ধীরে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সুবহা-নাল্লাহ শব্দের অর্থ সেই আল্লাহ বা সত্তা যিনি কিনা সব দুর্বলতা এবং অক্ষমতা থেকে মুক্ত। জাগতিক মানুষের চিন্তা-চেতনা, কর্ম, জীবন-মৃত্যু এবং ভোগবিলাসের যে দুর্বলতা রয়েছে তা মহান আল্লাহপাকের নেই। আল্লাহর অনেক সৃষ্টি, কর্ম এবং ইচ্ছার সন্ধান লাভ কোনো মানুষের মন-মস্তিষ্কের দ্বারা সম্ভব নয়। তাফসিরকারকগণ আল্লাহর সুবহান শব্দের তাৎপর্য বোঝানোর জন্য পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতটির উদাহরণ টানেন। হুজুরে পাক (সা.)-এর পবিত্র মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন- সুবহা-নাল্লাজি আসর বি’আবদিহি লাইলাম মিনাল মাসজ্বিদিল হারমি ইলাল মাস্জ্বিদিল আক্বছোয়াল্লাজি বা-রক্না হাওলাহু লিনুরিয়াহু মিন্ আ-ইয়া-তিনা, ইন্নাহু হু অস্ সামিউল বাছির। আয়াতটির সরল অর্থ হলো- মহিমাময় তিনি। যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়; যার চারদিকে বরকতময় করেছি যেন আমি তাকে কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি, নিশ্চয়ই তিনি শোনেন, দেখেন।
মেরাজ বা ঊর্ধ্বগমন ইসলামের একটি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ এবং রহস্যঘন বিষয়। রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে পবিত্র নগরী মক্কার কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেম গমন ছিল একেবারেই অসম্ভব একটি বিষয়। প্রায় পনেরশ মাইলের এই দূরত্বই শেষ নয়- জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা থেকে রসুল (সা.) বোরাক নামক এক আশ্চর্য প্রাণীর পিঠে চড়ে রওনা করেন ঊর্ধ্বালোকে। লাখ লাখ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের অসীম প্রথম আসমান পাড়ি দিলেন। এরপর একে একে সাতটি আসমান পাড়ি দিয়ে চলে গেলেন আল্লাহর আরশে আজীমে। তারপর জান্নাত-জাহান্নাম, বিখ্যাত নবী এবং রসুলগণ এবং ফেরেশতাগণের সাক্ষাৎ লাভ করে মহান প্রভুর দিদার লাভ শেষে পুনরায় মক্কায় ফিরে এলেন। হুজুর (সা.) যখন তার গৃহে ফিরে এলেন এবং বিছানার কাছে গেলেন তখন বিছানার তাপমাত্রা এমন ছিল যা দেখে যে কেউ অনুমান করতে পারবেন যে, এই কিছুক্ষণ আগে সেখানে কেউ একজন শুয়েছিলেন।
মেরাজের পরের দিন রসুল (সা.) যখন এ ঘটনা লোকজনকে বললেন তখন বিশ্বাসীগণ একবাক্যে বলে ওঠেন- সুবহা-নাল্লাহ! নিশ্চয়ই নবী সত্য বলেন এবং অসীম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ যখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই যে কোনো কর্ম নিষ্পন্ন করতে পারেন। অন্যদিকে অবিশ্বাসীরা শুরু করল তুমুল সমালোচনা। আল-কোরআনের তাফসিরকারকগণ সূরা বনী ইসরাইলের আলোচ্য আয়াতের সুবহা-নাল্লাজি শব্দের মধ্যেই মেরাজের তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন। বিষয়টি জটিল এবং অতীব কঠিন যা কিয়ামত পর্যন্ত কোনো মানুষের মন মস্তিষ্ক চিন্তা করে কূলকিনারা হদিস করতে পারবে না। আর এ কারণেই আয়াতের শুরুতে ইঙ্গিত করা হয়েছে- ঘটনাটি ঘটিয়েছেন সেই আল্লাহ যিনি কিনা সব দুর্বলতা এবং অক্ষমতা থেকে মুক্ত। ঘটনাটি যদি ইহলৌকিক বুদ্ধি দ্বারা বোঝা সম্ভব হতো তবে আল্লাহ আয়াতের শুরুতে সুবহা-নাল্লাজি দিয়ে শুরু না করে আলহামদুলিল্লা হিল্লাজি আসরাবি আবদিহি বলতে পারতেন।
ইসলামী চিন্তাবিদগণ মুমিন-মুত্তাকি বান্দাদের তাদের রবের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, হুকুম আহকামের ওপর পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস এবং আস্থা এনে আত্মসমর্পণ করার উপায় হিসেবে কতগুলো নিয়ামক সূত্রের উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, গভীর মনোযোগ সহকারে নিজের দিকে খেয়াল করা। এরপর অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে আল্লাহর সৃষ্টির দিকে নজর দিয়ে সৃষ্টিরহস্য বোঝার চেষ্টা করা। যেখানে মানুষের চিন্তাচেতনা কোনো সৃষ্টির অনুপম রহস্য দেখে অতি আশ্চর্য হয়ে ভাবতে পারবে এমন কর্ম কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়- একমাত্র আল্লাহই পারেন এবং তখন যদি বান্দার মুখ দিয়ে সুবহা-নাল্লাহ বের হয়ে আসে তবে আশা করা যায় শব্দটির রুহানি ফায়েজ বান্দার তকদিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।
অহঙ্কারী মন, অসম্পূর্ণ জ্ঞান এবং ধ্যানহীন দৃষ্টি নিয়ে আল্লাহর বিশালত্ব পরিমাপ করা যায় না। একটি বিশ্বাসী মন, বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক, সুস্থ ও নীরোগ দেহ এবং চমৎকার সময়ই কেবল বান্দাকে সুযোগ করে দেয় বরকতময় সত্তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের মাঝে সুবহা-নাল্লাহ শব্দের মাঝে বিলীন হওয়ার জন্য। সম্মানিত পাঠক যদি জিজ্ঞাসা করেন- আমি কখন এবং কীভাবে সুবহা-নাল্লাহ বলি? এটা যদিও ব্যক্তিগত বিষয় তবুও বলছি- কারণ বাস্তব উদাহরণ দিলে অনেক জটিল বিষয় পানির মতো সহজ হয়ে যায়-
(১) সময় পেলে আমি প্রায়ই আমার পাঁচটি ইন্দ্রিয় নিয়ে ভাবি। আমার চোখ কি করে তাবৎ দুনিয়ার লক্ষ কোটি রঙ, রূপ, দৃশ্য আলাদা আলাদা করে দেখতে পারে এবং মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারে তা নিয়ে যেমন চিন্তা করি তেমনি চিন্তা করি, কোনো দৃশ্য দেখলে আমি কীভাবে ভয় পাই, লজ্জা পাই, আনন্দ লাভ করি, লোভাতুর হই এবং মুগ্ধ হয়ে পড়ি! আমার কান আমাকে কী করে লাখ লাখ কোটি সুর মূর্ছনা, তাল-লহরি কিংবা কুহুতান-কলতানে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমার কানের সঙ্গে হৃদয় মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয় সত্তা কীভাবে নাচানাচি করে এসব ভেবে আমি অসীমের তরে হারিয়ে যাই ক্ষণে ক্ষণে। আমার নাক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের বাইরে লক্ষ কোটি সুমিষ্ট এবং কুমিষ্ট ঘ্রাণ আশ্বাদন করানোর মাধ্যমে কখনো জীবনকে করে তোলে উপভোগ্য আবার কখনো কোনো কুমিষ্ট গন্ধের মাধ্যমে জানিয়ে দেয় সতর্ক সংকেত। আমার জিহ্বাটিও এক অপরূপ মহিমায় সৃষ্টি করা হয়েছে। চোখ বুঝে কান বন্ধ করে এমনকি নিঃশ্বাস বন্ধ করেও যদি জিহ্বার ওপর তেঁতুল, কলা, আম, জাম, ইলিশ, কাঁঠাল বা লইঠ্যা মাছের ফ্রাই রাখি তবে মুখ, দাঁত, ঠোঁট এবং চোয়ালকে বলে দিতে হবে না পরবর্তী করণীয় কি? আমার ত্বক আমাকে বসন্তের বাতাসের স্পর্শ, প্রিয়ার সংস্পর্শ, নদী-সমুদ্র-পুকুর কিংবা মহাসমুদ্রের সংস্পর্শে এনে বিমোহিত করে দেয়। সামান্য একটু স্পর্শের জন্য আমি যেমন অনেক কিছু জলাঞ্জলি দিতে পারি তদ্রƒপ একই স্পর্শকে এড়িয়ে চলার জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করতে পারি।
(২) আমি আমার মাথাটি নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে মস্তিষ্ক বা ঘিলু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি। আমার মস্তিষ্কে একশ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কম্পিউটার বা সুপার কম্পিউটারটির মূল্য এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। এত দামি কম্পিউটারের স্মৃতিশক্তি, গণনা করার ক্ষমতা এবং পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আমার মাথার একশ বিলিয়ন অর্থাৎ দশ হাজার কোটি নিউরনের মধ্যে মাত্র একটি নিউরনের সমান। এই যদি হয় বাস্তব অবস্থা তাহলে আল্লাহ আমাকে যে বিনামূল্যে মাথাটি দিয়েছেন ওটার দাম কত? কমপক্ষে দশ হাজার কোটি গুণ এক হাজার কোটি টাকার সমান। এমন একটি মহামূল্যবান মাথা নিয়ে আমি যদি দরিদ্র থাকি কিংবা নিজেকে হতভাগ্য মনে করি তবে আমার মতো বান্দার জাহান্নাম ছাড়া অন্য কোনো গতি হতে পারে না।
(৩) শরীরের ২০৬ খানা হাড়ের কথা চিন্তা করতে গিয়ে আমি আমার শৈশবের কথা স্মরণে আনি। আমার জন্মের সময় অন্য সবার মতো আমার শরীরে ২৭০ খানা হাড় ছিল। আমার বয়স ৩০ বছর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী করে ৬৪ খানা হাড় বিলীন হয়ে ২০৬ খানা হাড়ে পরিণত হলো এবং কেন হলো- এই চিন্তা আমাকে যতটা না আশ্চর্য করে তারচেয়েও বেশি আশ্চর্য করে তখন আমি ভাবি একটি মহাজাগতিক হুকুম যা কিনা রুহ হিসেবে পরিচিত তা আমার হাড়গুলোকে চৌম্বক শক্তি দিয়ে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে। আমার রুহের রয়েছে ত্রিমুখী চৌম্বক শক্তি। প্রথম শক্তি দিয়ে এটি হাড্ডিগুলোকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে। দ্বিতীয় শক্তি দ্বারা এটি আমাকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে। তৃতীয় শক্তি দ্বারা এটি আমাকে মহাশূন্যের গ্রহ-উপগ্রহ এবং নক্ষত্রসমূহের মহাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে এমনভাবে সংযুক্ত করে রাখে যাতে আমি শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে জমিনে চলাফেরা করতে পারি- লম্ফ দিতে পারি কিংবা পাহাড়-সমুদ্র-মহাশূন্যে টিকে থাকতে পারি।
(৪) মৃত্যুর কথা চিন্তা করার সময় আমার জন্মের পূর্বক্ষণের কথা স্মরণ করি যখন কিনা আমাকে উলঙ্গ করে দুনিয়াতে দীন-হীন এবং অসহায় করে পাঠানো হয়েছিল। মৃত্যুর মাধ্যমে আমার রুহটি যখন বের করে নেওয়া হবে তখন সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের ২০৬ খানা হাড়ের মধ্যকার চৌম্বক শক্তিজনিত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। শরীরের আসমান ও জমিনের মহাকর্ষণ ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আমার এই দেহ সবার জন্য অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাবে। পচন ও দুর্গন্ধ ঠেকানোর জন্য আমাকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হবে। কিয়ামতের পর আমাকে পুনরায় জীবিত করা হবে এবং উলঙ্গ অবস্থায় হাশরের ময়দানে হাজির করে আল্লাহ তার সিংহাসনে আসীন হয়ে যখন সব মানবমণ্ডলীকে জিজ্ঞাসা করবেন- লিমানিল মুলকুল ইয়াউম? অর্থাৎ আজকের রাজত্ব কার? তখন সমবেত মানুষের সঙ্গে আমিও বলে উঠব- লিল্লাহিল ওয়াহিদিল কাহহার।
সম্মানিত পাঠক! আমি আমার লেখার শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আচ্ছা বলুন তো কোনো এক জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে চাঁদের আলোতে অবগাহন করতে করতে একাকী নির্জনে শুয়ে কিংবা বসে আমি যদি উল্লিখিত চারটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করি তাহলে আমি কি সুবহা-নাল্লাহ না বলে থাকতে পারব? কিংবা আপনি কি পারবেন?