“আমার ধর্মকর্ম যদি আমাকে পরিবর্তন না করে, সেই ধর্মকর্ম আমার কাজে আসবে না। না দুনিয়াতে, না আখেরাতে। বড় আলেম, মাওলানা ও খতিব হলেও কাজ হবে না, যদি তিনি অন্যের হক নষ্ট করেন। যার হক বা পাওনা নষ্ট হলো- সে যদি স্বেচ্ছায় মাফ করে না দেয় তাহলে হক নষ্টকারী ব্যক্তির পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। হালাল রুজি ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত। আয়-রোজগার যদি হালাল পথে উপার্জিত না হয় তাহলে ইবাদত কবুল হবে না। ওজনে কম দেয়া, ব্যক্তির টাকা মেরে দেয়া, সরকারের জায়গা দখল করে মার্কেট বা দোকান করা, অন্যের জায়গা দখল করে বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া, ঘুষ খাওয়া, মিথ্যা কথা বলা, ধোঁকাবাজি করা, নেয়ার সময় ঠিক নেয়া দেয়ার সময় কম দেয়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল কারসাজি করে কম দেয়া, নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন করা, নারীর দিকে কুমতলবে দৃষ্টি দেয়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, খাদ্যদ্রব্যসহ আল্লাহ প্রদত্ত যেকোনো জিনিসের অপচয় করা ইত্যাদি থেকে কোনো মুসলমান যদি বিরত না থাকে তাহলে তাকে মুমিন বা ঈমানদার বলা যাবে না। তোমার কাজ কেউ না দেখলেও আল্লাহ সব কিছু দেখছেন। তা ছাড়া তোমার অন্তরকে জিজ্ঞাসা করো তুমি সব কিছুই আল্লাহর বিধান অনুযায়ী করছ কি না। যদি না করে থাকো, তাহলে তোমার দোয়া কিভাবে কবুল হবে? তোমার দোয়া কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত খাস দিলে (বিশুদ্ধ অন্তর), তওবা করা (পুনরায় পাপ কাজ না করার জন্য সংকল্প)। ব্যবসায়, চাকরি বা যেকোনো কাজে যদি প্রচুর টাকা ক্ষতি হয় তার পরও মিথ্যার আশ্রয় নেবো না- এ ধরনের মুমিনরাই জান্নাতবাসী হবেন। ঈমানদার সেই ব্যক্তি যার অন্তর-ঘুষ খাওয়া, মিথ্যা বলা এবং ধোঁকাবাজির সময় বাধা দিলো। ঘুষের টাকা বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকায় হজ করলে সেই হজ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। অনেক মানুষ আছেন- যারা প্রতি বছরই হজ করেন। আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং হজ পালনের সব বিধিবিধান অনুসরণ করে যারা হজব্রত পালন করেন এবং হজ পালন শেষে সব ছগিরা কবিরা গুনাহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন- তিনিই সদ্যভূমিষ্ঠ নিষ্পাপ শিশুর মতো। নিজেকে এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, আমাদের হজ পালন কি সেভাবে হয়? হালাল বা বৈধ আয় ছাড়া হজ পালনে ত্র“টি থাকবেই। লোক দেখানো হজ, রোজা, জাকাত, নামাজ আখেরাতে কোনো কাজে আসবে না।
৫০-৬০ বছর আগে বাংলাদেশে এত মসজিদ-মাদরাসা ছিল না। ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হয়। বিশ্বের কোনো রাজধানী শহরে এত মসজিদ নেই বলে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এখন অতি মনোরম সাজে সজ্জিত মসজিদ নগরীর অলি গলিতে দেখা যায়। অনেক মসজিদে এসি লাগানো হয়েছে। মাদরাসাগুলোর চাকচিক্য বেড়েছে। মুসল্লির সংখ্যাও কয়েক গুণ বেড়েছে। সপ্তাহে এক দিন শুক্রবার, ঈদের নামাজের মতো মসজিদে উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়। মাদরাসার ছাত্র সংখ্যাও বেড়েছে। এসব ভালো লক্ষণ। কিন্তু প্রশ্ন, দেশে কি অপকর্ম বেড়েছে নাকি কমেছে? মুসল্লি বাড়লে, মাদরাসায় ছাত্র ও শিক্ষক সংখ্যা বাড়লে, দেশে নৈতিকতার উন্নতি ঘটবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে নৈতিকতা ও মানবতার প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ চলছে কেন? ৫০ বছর আগে দেশে যে পাপাচার হতো-সেটা এখন বহু স্তরের বিপণনের মতো শত গুণ বেড়েছে। ৫০ বছর আগে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, বোমাবাজি, চাপাবাজি, চালবাজি, ধান্ধাবাজি, চাপাতিবাজি- এসব কথা শোনা যায়নি। এখন ডিজিটাল ও প্রযুক্তির নামে এসব পাপাচার শব্দ বাস্তবে প্রয়োগ ঘটছে বাংলাদেশব্যাপী। বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক ও সহনশীল এ কথাও আমরা বহু বছর ধরে শুনে আসছি। বাস্তবে এর মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ধার্মিক ও সহনশীল মানুষের দেশে পাপাচার নানা শাখা-প্রশাখায় এত বিস্তৃতি লাভ করল কিভাবে? ধার্মিক মানুষ তো পাপকাজে বাধা দেবে। এটা তো নবীর কাজ। নবীর কাজ যদি আমি না করি তাহলে তো নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করা অন্যায়। তারা তো বকধার্মিক। লোক দেখানো বা অনুষ্ঠাননির্ভর অভ্যাসে পরিণত হওয়ার ধর্ম। এ ধরনের ধর্ম ইসলাম স্বীকার করে না। ইসলাম একটি বাস্তবধর্মী-জীবন্ত ধর্মের নাম। ইসলাম কোনো ব্যবসায়ী বা বণিকধর্মী ধর্ম নয়। ইসলাম কেনাবেচা করা যায় না। আসল কথা হলো, আগের জমানার মানুষ ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান ডিজিটাল যুগের মানুষের চেয়ে সৎ ছিল। নৈতিকতা ও মানবতা তাদের মধ্যে শক্ত ইটের মতো হৃদয়ে প্রোথিত ছিল বলেই বর্তমানের মতো ধর্ষণ, খুন, গুম, অপহরণ, পরের জমি, বাড়ি দখল, ঘুষ ইত্যাদি ঘটেনি। নারী জাত মায়ের জাত- তা এখন সেক্সুয়াল কমোডিটিতে রূপ নিয়েছে। বাস, হাসপাতাল, লঞ্চ, স্টিমার ট্রেন, নৌকা, পার্ক, ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বইমেলা ও নববর্ষ উৎসবে, এমনকি অফিস-আদালত, বাসাবাড়িতে নারী ধর্ষিত হচ্ছে। উৎপীড়ন, নিপীড়ন, বলাৎকার, ধর্ষণ, গণধর্ষণে প্রতিদিন মা জাতি আজ লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত হচ্ছে। বর্বর যুগেও এমন কান্ড ঘটেনি, যা কথিত ডিজিটাল বাংলাদেশে ঘটছে। মসজিদ-মাদরাসা বাড়লেই যে ঈমান বাড়বে, এ কথাও সত্য নয়। আমার ধর্মকর্মে আল্লাহ রাজিখুশি আছেন কিনা, সেটা বোঝার ক্ষমতা অবশ্যই একজন মুসলমানের জানতে হবে, অন্যথায় সে মুমিন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না আল্লাহর কাছে। আর যে ব্যক্তি মুমিন বা ঈমানদার সেটা প্রকাশ করবে অন্যরা। তার চালচলনেই তা প্রকাশ পাবে। মুমিনের আরেকটি পরিচয় হলো, তার কথার সাথে কাজের মিল থাকবে। দেশে যেভাবে জেনা ও পরকীয়া হচ্ছে, তাতে আমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার তারা কেন জোরালো প্রতিবাদ করছেন না? ঈমানদার মানুষের কাজই তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, প্রতিবাদ করা। মৃত্যুকে ভয় পেলে সে কিভাবে নিজেকে ঈমানদার হিসেবে আল্লাহর কাছে দাবি পেশ করবে। মসজিদ-মাদরাসা, ছাত্র, শিক্ষক, মুসল্লি বাড়লেই দেশে ঈমানদার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, এ কথা সঠিক নয়। দেশে ঈমানদার মানুষের সংখ্যা বাড়লে অশ্লীলতা চরম আকার ধারণ করত না। দেশে আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী রা:-এর মতো একজন ঈমানদার মানুষ থাকলে বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা এত কদর্য রূপ ধারণ করত না। আল্লাহর মদদ বা সাহায্য না আসার কারণ আমাদের মধ্যে খলিফা ও সাহাবাদের মতো ঈমানের চরম ঘাটতি রয়েছে। দোয়া কবুল না হওয়ার কারণ আমরা পাপী। তওবা করার পরও একই পাপ বারবার করি। পাপীদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না (সহিহ হাদিস)। সংখ্যার বিচারে ঈমানের যাচাই-বাছাই করা যায় না। ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়, একটি জীবনব্যবস্থার নামও। ইসলামে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, পরিবেশনীতি, পরিবার পরিকল্পনা নীতি, শাসননীতি, প্রতিরক্ষানীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ সব নীতিই কুরআনে লিপিবদ্ধ রয়েছে বলেই ইসলামকে বলা হয় একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার নাম।
আবারো বলব, আমার ধর্ম যদি আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত না করে সেটা ধর্মের দোষ নয়, দোষ আমার। কারণ ধর্মকে আমি চিনতে ও বুঝতে শিখিনি। ইসলাম আংশিক মানার ধর্ম নয়, পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার নাম ইসলাম। ইসলামের কিছু মানলাম কিছু মানলাম না, তাকে মুমিন বলা যাবে না। ইসলাম অনুষ্ঠাননির্ভর ও অভ্যাসজনিত ধর্মও নয়। আমরা পান, সিগারেট, মদ, হারাম দ্রব্য গ্রহণ করে অভ্যাসে পরিণত করেছি। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ জানলাম-শুনলাম; কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তা পালন করলাম না, সেটাও ইসলাম নয়। আল্লাহর বিধিবিধান নবী করিম সা:-এর জীবনব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। নবী করিম সা:-এর জীবনব্যবস্থায়ই ইসলামের প্রকৃত রূপ খুঁজে পাওয়া যাবে। নবী করিম সা: ইসলামের প্রতীক। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাইলে নবী করিম সা:-এর ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন অনুসরণ করতে হবে পুরোপুরিভাবে। দুনিয়া সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত একমাত্র মানবসভ্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে খোলাফায়ে রাশেদার ৩০ বছরের শাসনামলে। এটাই ছিল বিশ্বের সোনালি যুগ।
আল্লাহ নিজেই মুমিনদের অভিভাবক, তিনি তাদের বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর তাগুত হলো কাফেরদের অভিভাবক। এরা তাদের অন্ধকারের পথের দিকে ধাবিত করে। তারাই চিরজাহান্নামি, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। যে ব্যক্তি তাগুতকে বিশ্বাস না করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, সে ব্যক্তি এমন এক শক্ত রশি ধারণ করে, যা ছিন্ন হয় না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী। তাঁর আসন আসমান ও জমিন পরিবেষ্টিত। এদের হেফাজতে তাঁর কোনো কষ্ট হয় না। তিনি সমুন্নত, মহামহিম (সূরা বাকারাহ : ২৫৫-২৫৭)।
জালিমরা তো একে অপরের বন্ধু, আল্লাহ হলেন মুত্তাকীদের বন্ধু (সূরা জ্বাছিয়াহ : ১৯)। একজন উত্তম মানুষ হতে চাইলে প্রার্থনার মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে ধ্যানগতভাবে বিলীন হওয়ার গুরুত্ব আধুনিক মনোবিজ্ঞানে প্রমাণিত হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসীরা সরাসরি আল্লাহর রহমত ও প্রশান্তি লাভ করে। যেসব মানুষ দৈনিক পাঁচবার অজুর মাধ্যমে শরীরের মূল পাঁচটি অঙ্গে ওয়াটার থেরাপি প্রয়োগ করে মহান স্রষ্টার স্মরণে একাগ্রচিত্তে আত্মসমর্পণ করে, অন্তরে তারাই প্রকৃত মানসিক শান্তি লাভ করে এবং তারাই ট্রেস ও টেনশনজনিত যাবতীয় রোগ, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ুর রোগ, ইনসোমনিয়া (অনিদ্রা) ডায়াবেটিস, হৃদরোগ থেকে অনেকটা মুক্ত থাকে। সেজন্যই আল্লাহপাকের তরফ থেকে নবী করিম সা: তাঁর উম্মতের কল্যাণের জন্য দেয়া হয় মেরাজের সবচেয়ে সেরা উপহার দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।”