ইসলামি পরিভাষায় এতিম বলা হয় তাদের, শিশু অবস্থায় যাদের বাবা মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ বছর বয়স অর্থাৎ বালেগ হওয়ার আগে বা বিবাহ হওয়া পর্যন্ত কোনো শিশুর বাবা মারা গেলে সেই শিশুই এতিম। পশু জগতে বাচ্চাদের মা মারা গেলে সেই বাচ্চারাও এতিম হয়ে যায়। তবে মানুষের সাথে পশুদের অনেক পার্থক্য রয়েছে। পশুদের স্ত্রীরা অসুন্দর হয় আর পুরুষরা হয় সুন্দর। সে জন্য সিংহীর কেশর হয় না; কিন্তু সিংহের কেশর হয়। মোরগের মাথায় ফুল হয়। ময়ূরীর হয় না; ময়ূরের পেখম হয়। পশু আর মানুষ এক নয়; সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আলাদা। মানুষ শ্রেষ্ঠ প্রাণী।
এতিমদের সম্পদ সংরক্ষণ করার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘এতিমের সম্পদ তাদেরকে ফেরত দিয়ে দাও; ভালো মাল খারাপ মালের দ্বারা বদলিয়ে নিও না; আর তাদের মাল তোমাদের মালের সাথে মিশিয়ে খেয়ে ফেলো না; এটা বড়ই গুনাহ’ (সূরা নিসা : ২)। যে মানুষ বিশেষ করে এতিমের কাছে আত্মীয়দের মধ্য থেকে এতিমদের অভিভাবক নিযুক্ত হবেন তিনি যেন এতিম সন্তান বালেগ না হওয়া পর্যন্ত যত্নসহকারে তাদেরকে বড় করে তোলেন। এতিমের প্রতি কোনো প্রকার লোভ লালসা কিংবা তাদের সম্পদের প্রতি লোভলালসা ছাড়া দায়িত্ব নেয়ার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ আদেশ রয়েছে। আর আল্লাহর পক্ষ হতে যা কিছু করা; না করা; আদেশ নিষেধ তা সবই ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। সে জন্য এতিমদের ব্যাপারে লোভলালসা করা যেমন সে লোভ সম্পদের হোক আর সুন্দরের হোক তা ত্যাগ করে যথাযথভাবে বালেগ হওয়া পর্যন্ত তাকে দেখাশোনা করা অত্যাবশ্যক। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে থেকে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো এতিমের দায়িত্ব না নেয় তাহলে সমাজের কারো ওপর সে দায়িত্ব বর্তায়। সমাজও যদি সে দায়িত্ব গ্রহণ না করে তবে সে দায়িত্ব রাষ্ট্রপক্ষকে পালন করা জরুরি হয়ে যায়। এটা নিশ্চয় কষ্টের বিষয় যে, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে এতিম লালনপালনের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে, বেসরকারিভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু এতিমখানা এ দেশের যত্রতত্র দেখা যায়। সেসব এতিমখানার সবই মাদরাসারূপে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
সমাজের বিত্তবান লোকেরা এতিম সন্তানদের লালনপালন করার জন্য এতিমখানারূপে এসব প্রতিষ্ঠান তৈরি করে থাকেন। সওয়াবের বা পুণ্যের আশায় সেখানে কুরআন হাদিস শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। আর এই পর্যন্ত করতে পেরে বিত্তবানেরা আত্মতৃপ্তিতে থাকেন। আবার একা একা যাদের পক্ষে এতিমখানা তৈরি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তারা কয়েকজন মিলে একটা এতিমখানা তৈরি করে মাসিক চাঁদার ভিত্তিতে অথবা দান সদকা ফিতরা ও কোরবানির চামড়া বিক্রির পয়সা দিয়ে সেখানে এতিম শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকেন। এখানেও কুরআন হাদিসের শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় পুণ্যের আশায়। যেসব এতিমের পিতার রেখে যাওয়া সম্পদ রয়েছে তাদের আত্মীয়স্বজনরা অনেক সময় সেই এতিম ছেলেমেয়েকে নিজেদের কাছে রেখে স্কুল-কলেজে পড়িয়ে চাকরিবাকরি বা ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যবস্থা করে থাকেন। এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু এতিমখানায় পড়াশোনা করা এতিমরা কুরআনের হাফেজ হয়ে সরকারিভাবে তেমন কোনো চাকরির প্রত্যাশা করতে পারেন না। তারা হয় কোনো মসজিদের ইমাম অথবা মোয়াজ্জিন হয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। এই হলো এতিমদের প্রতিষ্ঠিত করা সমাজের সাধারণত চলমান প্রক্রিয়া। অথচ দেশে কত শত চাকরি রয়েছে। সেসব চাকরিতে যোগ দিয়ে এতিমরা নিজেদের আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করুক এই ধরনের চিন্তাভাবনা সমাজের কোনো মানুষের চেতনায় কেন জানি আসে না। এতিম মানেই যেন মসজিদ-মক্তবের ইমাম মুয়াজ্জিন অথবা জানাজা-দোয়া পড়া কিছু ব্যক্তি। এখন পর্যন্ত কোনো এতিমকে দেশের চাকরির বাজারে অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো চেয়ারে বসতে দেখা যায় না। শুধু এই দু’টি কাজের জন্য তো শরিয়তে এতিমের মাথায় হাত বুলানোর কথা বলা হয়নি। এতিমের মাথায় হাত বুলানোর অর্থ শুধু এইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এতিমের মাথায় হাত বুলানোর অর্থ হলো এতিমদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। তাদের সমাজে আর্থিক ও মানবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া; এটি সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনেরও একটি প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। এতিমখানা থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে কিছু ছেলে মসজিদ-মক্তবের ইমাম-মুয়াজ্জিন হতে পারেন; কিন্তু বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে সমাজে এতিম হিসেবে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়ে ওঠেন। দেখা গেছে যারা ইমাম হিসেবে মসজিদে মক্তবে চাকরি নিয়ে থাকেন তাদেরও বেতন এত সামান্য যে, এই স্বল্প বেতনের চাকরি করে সমস্ত জীবনই তাদের আর্থিকভাবে এতিমই থাকতে হয়। এতিমখানা থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষে এসব ছেলেমেয়ে না পারেন চাকরি করতে; না পারেন রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে কোনো প্রকার শারীরিক পরিশ্রমের কোনো ভারী কাজ করতে অথবা অর্থাভাবে কোনো ব্যবসাবাণিজ্য করতে। আর মেয়ে এতিমদের তো আরো করুণ পরিণতি অপেক্ষা করে; তাদের জীবনভর পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালিয়ে নিতে হয়।
সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের কত বড় বড় প্রকল্প তৈরি করা হয়; কেন এই অসহায় এতিমদের নিয়ে বড়সড় কোনো প্রকল্প হয় না তা আমাদের জানা নেই। আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা বা সঙ্কীর্ণতা যা-ই বলি না কেন, দেখা যায় এতিমখানা তৈরি করে দেয়া বিত্তবানেরা তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েকে দেশে-বিদেশে নাম করা বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করাতে পাঠান। অন্য দিকে অন্যের অসহায় এতিম ছেলেমেয়েদের নিজের হাতে তৈরি করা প্রতিষ্ঠানে (এতিমখানায়) রেখে খুব পুণ্যের কাজ করেছেন মনে করে আত্মস্বস্তিতে থাকেন। তথাকথিত এসব মহৎ ব্যক্তিগণ পরিষ্কার করে জানেন যে, তাদের ছেলেমেয়েরা যদি তাদেরই হাতে তৈরি করা এসব প্রতিষ্ঠানে (এতিমখানায়) পড়াশোনা করে; তাহলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। অথচ তারাই পুণ্যের আশাতে অসহায় এতিম ছেলেমেয়েদের এসব প্রতিষ্ঠানে (এতিমখানায়) রেখে শিক্ষা দিয়ে একটি জটিল জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সা: তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ করে বলেছেন ‘তোমরা নিজেদের জন্য যা পছন্দ করো অন্যের জন্যও যেন সেটাই পছন্দ করো’। দেখা যাচ্ছে আমরা তার অনুসারীরা রাসূল সা:-এর এই চেতনার বিপরীত চেতনাকে জীবনে লালনপালন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।
এতিমদের প্রতি ইনসাফের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেÑ ‘তাদের এ কথা খেয়াল করে ভয় করা উচিত যে, যদি তারা নিজেদের অসহায় সন্তান রেখে মরে যেত, তাহলে মরার সময় তাদের সন্তানের জন্য কেমন ভয় করত; তাই তাদের উচিত যেন তারা আল্লাহকে ভয় করে এবং সঠিক কথা বলে’ (সূরা : নিসা : ৯)। এই সূরার ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-‘যারা জুলুম করে এতিমের মাল খায় তারা আসলে নিজেদের পেট আগুন দিয়ে ভর্তি করে এবং তাদের নিশ্চয় জ্বলন্ত আগুনে ফেলা হবে’। এতিমদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করে দেয়া ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের অতিবো জরুরি কর্তব্য। এ কর্তব্যে অবহেলা করলে মৃত্যুর পরের জীবনে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করা হবে এবং এ অপরাধে শাস্তিভোগ করতে হবে। সে কারণে এতিমদের ব্যাপারে সতর্ক হতে না পারলে আত্মীয়স্বজনের ওপর এবং সে জাতির ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে লানত উপস্থিত হতে পারে। কোনো মানুষ এতিমদের সম্পদের ওপর লোভ করতে পারে সে ব্যাপারে সূরা মাউনে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে; ওই লোকই তো এতিমকে ধাক্কা দিয়ে তাড়ায় এবং মিসকিনদের খাবার দিতে উৎসাহ দেয় না’ (সূরা মাউন : ১-২-৩)। আল্লাহকে অস্বীকারকারী লোকজনই এতিমদের ব্যাপারে উদাসীন। সামাজিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূর করতে হলে আল্লাহর নির্দেশনাকে শিরোধার্য করে এতিমদের ব্যাপারে সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্যের বিষয়ে আরো যত্নশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া সুস্থ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরির জন্য অন্য কোনো বিকল্প আশা করা যায় না।
আমরা মনে করি সরকারিভাবে এতিমদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুব্যবস্থা করা দরকার। প্রয়োজনে এ বিষয়ে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। সুশীলসমাজ এবং সরকার যদি এ বিষয়ে সদইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে।